নিমগাছ আর অতিকায় দেয়ালের গল্প - ঋষি এস্তেবান

ঋষি এস্তেবান

সক্রিয় ছোটকাগজের লেখক...

সর্বশেষ লেখা

আপনি জীবদ্দশায় অপ্রাতিষ্ঠানিক থাকতে পারেন, কিন্তু প্রতিষ্ঠান নামের বুনোশুয়োর আপনাকে থাকতে দেবেনা কারণ, তাদের ‘ঘি’ বলেন আর ‘গু’ বলেন কোন কিছুতে ‘না’ নেই

বুধবার, ১৪ মার্চ, ২০১৮

নিমগাছ আর অতিকায় দেয়ালের গল্প

তার বাবা এবং তার বাবার বাবাও কবিরাজ ছিলো। 
তারা দুইভাই, নরিম আর করিম তারাও কবিরাজ। দুই বছর কয়েকদিন আগে তাদের বাবার মৃত্যু হয় তারপর থেকে দুই ভাই বাবার কবিরাজির দোকানে নিয়মিত বসে রোগী দেখে। 
গ্রামের নামেই ইউনিয়ন পরিষদের নাম। জেলা শহর থেকে দশমাইল উত্তরের মতিখালি মূলত কালিচুন নদীর পাড়ে বহু পুরোনো একটা বাজার। ধান পাট, তিল, তিসি, সরিসা, কলাই, ছোলা, মুশুরি, মুগ, নারকেল, সুপারির একটা বড় মোকাম। বৃহস্পতি এবং রবিবারে এখানে হাট বসে, খুব জমজমাট। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা আসে। ট্রলার বোঝাই ভূষিমালের চালান যায় সারাদেশে। মতিখালি বাজারেই নরিম করিমের কবিরাজি চিকিৎসা কেন্দ্র। বাজার থেকে সিকিমাইল দক্ষিণে তাদের বাড়ি। 
নামডাক আছে মতিখালি কবিরাজদের। দূর দূর এলাকা থেকেও তাদের চিকিৎসা পেতে রোগী আসে, দৃষ্টান্ত আছে যে, নামকরা ডিগ্রিধারী ডাক্তার কবিরাজ যে রোগীর চিকিৎসায় ব্যর্থ হয়েছে সেই রোগী মতিখালী কবিরাজের চিকিৎসায় নিরাময় হয়েছে। 
নরিম করিম কোনো ধরণের রাসায়নিক বা পেটেন্ড অষুধ ব্যবহার করে না, বাপ দাদার কাছ থেকে শেখা গাছ-লতা-পাতা-ছাল-বাকল-কন্দ-শেকড় থেকে তারা ঔষধ তৈরি করে।
বাবার মৃত্যুর দুই বছর পর তাদের মায়ের মৃত্যু হয়। মায়ের মৃত্যু তাদের সংসার অচল করে তোলে। বাধ্য হয়ে নরিম বিয়ে করে, নরিমের বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যে নরিমের শশুরবাড়ির গ্রামে করিমও বিয়ে করে। 
দুই ভাইয়ের দুই বউ আর নরিম করিম এই চারজনের সংসার। দুইভাই ছোটবেলা থেকেই বন্ধু, একসাথে খায়-ঘুমায়-ঘোরে-দোকানে বসে কিন্তু তাদের দুই বউ একজন আর একজনের সাথে ঠিকঠাক জোড়া লাগে না। তাদের দুই বউ স্বভাবে স্বার্থপর সংসারের হিসাব নিকাশে পাকা। 
দুই বউ মাঝে মাঝে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে নিজেদের মাঝে তর্কাতর্কি হালকা কলহে লিপ্ত হয়। এ বিষয়ে তারা দুইজন তাদের যে যার স্বামীর কাছে একজন আর একজনের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত অভিযোগ জানায়। 
তারা দুইভাই যে যার বউয়ের অভিযোগ শোনে আর যে যার বউকে বোঝায় ঝগড়াঝাটি না করে মিলে মিশে সংসার করার জন্য কিন্তু তাদের বউরা তাদের কথায় কোনো গুরুত্ব দেয় না তারা ঝগড়া কুটনা কুটনি চালিয়ে যায়।
বার বার বউদের অভিযোগ শুনতে শুনতে দুই ভাইয়ের মাঝেও একটা হালকা দাগ তৈরি হয় যা ক্রমাগত স্পষ্ট হতে হতে প্রায় অমোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছায়। 
একদিন দুই বউয়ের তর্কাতর্কির মাঝে নরিম করিম যে যার বউয়ের পক্ষে অংশ নেয়। তার কয়েকদিন পর দুই ভাইয়ের মাঝে বেশ বড় ধরনের ঝগড়া হয়ে যায়। তারপর নরিম করিমকে ডেকে বলে ‘ঝগড়াঝাটি করা খুব খারাপ কাজ। ঝগড়া না করে আয় আমরা যে যার মতো পরিবার নিয়ে পৃথক হয়ে যাই। করিম বলে ‘তুমি যা ভালো মনে করো তাই করো।’ তারপর তারা দুইভাই পাড়া প্রতিবেশি মুরুব্বীদের ডেকে একদিন যে যার সংসার আলাদা করে ফেলে। মালপত্র, ঘর, বাগানসহ বাড়ি, জমি, বাজারের দোকান সব নিজেদের মাঝে সমান ভাগ করে নেয়। দোকান ঘরের মাঝে কাঠের পার্টিশন দিয়ে দুইভাই দুই পাশে রোগী দেখা শুরু করে। 
গাছ গাছড়ার ওষুধ তৈরির জন্য নিম একটি বিশেষ ভেষজ গুণ সমৃদ্ধ গাছ। অনেক ধরণের রোগের চিকিৎসায় নিমের পাতা-ফুল-ফল-ছাল-শিকড় ব্যবহৃত হয়। 
করিমের বউ নিমগাছ পছন্দ করে না। নিমের পাতা-ফুল-ফল-ছাল-গন্ধ কিছুই সে সহ্য করতে পারে না। এমন কি নিমগাছ দেখলেই সে অস্বস্তি বোধ করে। অনেক ছোটবেলায় চুলকানি সারানোর জন্য এক কবিরাজ নরিমের বউকে নিমের পাতার রস খাইয়েছিলো। যা খেয়ে তার অনেকবার বমি হয়েছিলো সে দিনের পর থেকে নিমের নাম শুনলেই তার গা গুলিয়ে ওঠে আর নিমের গন্ধ নাকে ঢুকলেই শুরু হয় বমি কিন্তু তার স্বামীর কারবারের অন্যতম উপাদান নিম।নিমকে কেন্দ্র করে তার স্বামীর সাথে তার প্রায়ই ঝগড়া হয়। নিমের সাথে তার এই শত্রুতার কথা খুব দ্রুত তাদের পাড়া প্রতিবেশি সবাই জেনে যায়। তার স্বামী তাকে বোঝাতে চেষ্টা করে নিমগাছকে অপছন্দ করার কোনো কারণ নাই। নিম মানব জীবনের পরম উপকারি, নিমের ছায়া তার হাওয়া, গন্ধ এমনকি নিমের খাট-চেয়ার-টেবিল ব্যবহার করলে অনেক ধরণের রোগ হতে পারে না। কিন্তু এসব কথা নিমের প্রতি তার বউয়ের বিরাগ নির্মূল করতে পারে না। 
বউয়ের শান্তির সার্থে করিম নিমের কোনো কিছু বাড়িতে রাখে না, আনেও না। নিমের ওষুধপত্র দোকানেই তৈরি করে তবুও করিম দোকান থেকে বাড়ি ফিরলে বউ তাকে সাবান মেখে গোসল না করে ঘরে ঢুকতে দেয় না।
দিনের পর দিন বউয়ের মুখে নিমের বদনাম শুনতে শুনতে করিমের নিজের মধ্যে নিমের প্রতি এক ধরনের উদাসীনতা জন্ম নেয়, যা ধীরে ধীরে যা অধঃপতিত হয় অশ্রদ্ধায়। আরও কিছুদিন পরে এই অশ্রদ্ধা অধপতিত হয় ঘৃণায়। এটা হয় এটা ভেবে যে একটা গাছের কারণে যেহেতু সংসারে প্রতিনিয়ত অশান্তি সেহেতু এই গাছটার দরকার কি? সংসারের শান্তির চেয়ে তো আর একটা গাছ বড় হতে পারে না। সে নিমকে বাদ দেয় তার জীবন থেকে। নিম বাদ দিয়েই সে তার ওষুধ পত্র তৈরি করে কিন্তু বিষয়টা সে তার বউকে বলে না।
একদিন নরিম আর করিমের পরিবারের মাঝে তুমুল ঝগড়া হয়ে যায়। নরিম আর তার বউ জানে করিমের বউ নিমগাছ সহ্য করতে পারে না, এক্ষেত্রে করিমের বউকে শাস্তি দেয়ার জন্য নরিম আর তার বউ তাদের উঠানের মাঝের ভাগ করা সীমানার গা ঘেঁষে দশ হাত পরপর নিম গাছের চারা পুতে দেয়। এটা দেখে করিম চরম ক্ষেপে যায় আর তার ভাগের জমির সীমানাজুড়ে মিস্ত্রি ডেকে ইট-বালু-সিমেন্ট কিনে একটা লম্বা দেয়াল  তোলে,যার ওপাশে নরিমের লাগানো নিমের চারাগুলো আড়াল হয়। 
কিছুদিন পর নরিমের নিমগাছের চারাগুলো নিজেদের বড় বানিয়ে করিমের দেয়ালের উপর মাথা তোলে। এই দৃশ্যের জবাবে করিম আবার মিস্ত্রি ডাকে আর দেয়ালটা আরও উঁচু করে গেঁথে তোলে। নিম গাছগুলো আবার ঢাকা পড়ে দেয়ালের এপাশে। আরও কয়েক মাস পরে আবার দেয়ালের উপরে নিম গাছেরা উঠেআসে, যা করিমকে চরম ক্ষেপিয়ে তোলে, সে তার বিলের কিছু জমি বিক্রি করে সিমেন্ট, রড, বালি কেনে আর ভালো রাজমিস্ত্রি ডেকে দেয়ালটা গোড়া থেকে মজবুত করে গেঁথে পাঁচ মানুষ সমান উঁচু করে। দেয়ালের ওপাশে আবার নিম গাছগুলো ঢাকা পড়ে  আর করিম স্বস্থির নিঃশ্বাস ছেড়ে কবিরাজিতে মনোনিবেশ করে। 
মাত্র দেড় বছর পর নিম গাছগুলো করিমের দেয়ালের উপরে মাথা তুলে এপাশে উঁকি দেয়। করিম আবার জমি বিক্রি করে ইট সিমেন্ট বালি আনে, মিস্ত্রি ডাকে তারপর দেয়ালটাকে আরও উঁচু করে গেথে তোলে। আবার নিমগাছ অদৃশ্য হয় দেয়ালের ওপাশে। করিমও সন্তোষজনক নিঃশ্বাস ছেড়ে ফিরে যায় কাজে। 
তারপর আবার দুই বছর পর এক সকালে করিম দেখে তার দেয়ালের উপরে নিমগাছের মাথা উঠে এসে বাতাসে দোল খাচ্ছে। করিম আবার মিস্ত্রি ডাকে কর্জপাতি করে ইট বালু সিমেন্ট আনে আর দেয়ালটা আরও উঁচু করে গেঁথে তোলে। 
নরিম করিম সংসার ভাগাভাগির সময় দুই ভাই একখানা করে টিনের ঘর পেয়েছিলো ভাগে আর বাড়ির সাথের তার দাদা এবং বাবার গড়ে তোলা গাছ গাছালির বাগান, ক্ষেতসহ মোট জমি লম্বালম্বি সমান দুইভাগে ভাগ করে পশ্চিমপাশে করিম আর পূর্ব পাশে নরিম মালিকানা পায়। এছাড়াও বিলের কিছু জমি ছিলো তার বাবার যা তারা সমান ভাগ করে নেয়। 
পূর্ব পশ্চিম দুই পাশে দুই ভাইয়ের দুই বাড়ি তার মাঝে ক্রমাগত উঁচু হয়ে উঠছে দেয়াল! পরের বছর নিমগাছের সারি আবার মাথা তোলে দেয়ালের উপরে। করিম তার বিলের শেষ জমিখ- বিক্রি করে আবার দেয়ালটা আরও উঁচু করে তোলে। 
ক্রমাগত বহুউঁচু এই অদ্ভুত দেয়াল নিয়ে লোকেরা আলোচনা করতে থাকে। আশপাশের গ্রাম থেকে দু’একজন দু’একজন করে মানুষেরা এই দেয়াল দেখতে আসে... 
ক্রমশঃ এ কান থেকে ও কান করতে করতে আকাশ ছোঁয়া রহস্যময় দেয়াল আর নিমগাছ সম্পর্কিত নানান অদ্ভুত কাহিনী দিকবিদিক ছড়িয়ে পড়ে আর প্রতিদিন দেওয়াল দেখতে মানুষেরা আসতে থাকে। তারা আসে ঘুরে ঘুরে দেয়াল দেখে আশপাশের মানুষের কাছে এটা ওটা জিজ্ঞেস করে আশ্চর্য হয়ে ফিরে যায় আর মুখে মুখে ছড়িয়ে দেয় দেয়ালের নানান কাহিনী। এইসব বর্ণিল কুহক কাহিনী মানুষদের কৌতূহল জাগিয়ে তোলে আর টেনে আনতে থাকে দেয়াল দেখতে। 
প্রথমে কয়েকজন ভাজামুড়িওয়ালা দেয়ালের পাশে এসে দোকান পেতে বসে, পর পর আসে বাদামওয়ালা, বেলুনওয়ালা, বা"চাদের খেলনার দোকান, দ্রুত জায়গাটা মেলা হয়ে ওঠার প্রথম স্তর পার করে। তারপর গ্রামের একজন টিনের চালা তুলে সামনে বাঁশের বেঞ্চ পেতে একটা চায়ের দোকান খোলে, পরদিন একজন গায়ক আসে হারমোনিয়াম ঢোল, বাঁশি, দোতারা, বাদকদলসহ। তারা এসেই উঁচু সুরে পল্লির প্রেমের গান জোড়ে। এলো বেদেনিরা হাত সাফাই আর তাসের ম্যাজিক নিয়ে, বানর খেলা, সাপের নাচ, ভাগ্য গণনাকারী, আংটি আর পাথর বিক্রেতা, দরবারের তাবিজ বিক্রেতা, নাগরদোলা, চরকা খেলা, একে একে  যে যেখানে পারে বসে যায়। প্রতিদিন মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে ঘনিভূত হয়ে ওঠা মেলায়। শূন্যে ভাসা যাদুকর, দড়ির উপর হাঁটা আর অন্যান্য শারীরিক কসরৎ দেখানো একটা দল টিন দিয়ে কিছুটা জায়গা ঘিরে টিকিটে খেলা দেখাতে শুরু করে। চটপটির দোকানদার লাল সামিয়ানার তলে প্লাস্টিকের চেয়ার টেবিল সাজিয়ে নদীর ওইদিকে গাছের ছায়ায় দোকান পেতে বসে আর সাউন্ডবক্সে বাজিয়ে দেয় পুরানো দিনের পালাগান। সন্ধ্যা হতেই চটপটিসহ কয়েকটি দোকানে জ্বলে উঠে হ্যাজাকের ঝলমল আলো আর ছোট খোলা দোকানগুলোয় জ্বলে উঠে মোটা সলতের ল্যাম্প। পুরা জায়গাটা হয়ে উঠে হাসি আনন্দভরা রূপকথার রহস্য নগর! 
সন্ধ্যার পর ইউনিয়ন পরিষদের মেয়র তার সাঙ্গপাঙ্গ চৌকিদারসহ এসে ভারিক্কি চালে সবকিছু দেখে বুঝে মেলা পরিচালনার জন্য একটা কমিটি বানিয়ে দেয়, যে কমিটির প্রধান সে নিজে। 
পরদিন আসে সংবাদকর্মীরা। তারা আকাশছোঁয়া অদ্ভূত দেয়াল, নিমগাছ, নরিম করিমের ছবি, জমে ওঠা মেলার সংবাদ ছড়িয়ে  দেয় সারা দুনিয়ায়। 
প্রতিদিন নতুন বিষয় আর মানুষেরা এসে আরও জাকজমকপূর্ণ করে তোলে মেলা, তারপর চলে এলো সার্কাস আর যাত্রা গানের দল। 
মেলার প্রতিক্রিয়ায় মতিখালি বাজারের দোকানগুলো খরিদ্দার শূন্যতায় ধুকতে থাকে, অনেক দোকানদার মেলায় ছাবড়ার দোকান সাজিয়ে বসে। লাভ বুঝতে পারলে ব্যবসায়ীরা সেখানে হাজির হবেই। এখানেও রাতারাত গজিয়ে ওঠে টিনের চালার তিনটা ভাতের হোটেল।  
নিঝুম চুপচাপ মতিখালি হঠাৎ হয়ে ওঠে ব্যস্ত কোলাহল মুখর, বাজনাদার দলের ঢোল-বাঁশি-গান-হাসি-চিৎকার-কোলাহল বায়স্কোপ অলার প্রেমজুড়ি বাজিয়ে ঘুঙুর পায়ে নেচে নেচে ধারাবর্ণনা 
আরে তারা সবাই চলে গেল
কী চমৎকার দেখা গেল
খুদিরামের ফাঁসি হলো
ইন্দিরাগান্ধী চলে এলো
ছয়ই সেপ্টেম্বর যুদ্ধ হলো
পঁচিশ মার্চ মানুষ মলো
কী চমৎকার দেখা গেলো!
এই সব কিছু একহয়ে পাল্টে ফেলে এই এলাকার জীবনের রুটিন। 
মতিখালি, তার লাগোয়া গ্রামের  প্রায় সবাই মেলা থেকে কোনো না কোনোভাবে লাভবান হতে থাকে, কেউ পান-বিড়ির দোকান দিয়ে, কেউ বেগুনি ফুলরি ছোলাভুনা বিক্রি করে, কেউ বেলুন, মাটির খেলনা ইত্যাদির দোকান দিয়ে, কেউ জমি ভাড়া দিয়ে আর যুবকদের একটা অংশ ভলেন্টিয়ারের দায়িত্ব পায়। 
দূরের থানা থেকে এক ফুলওয়ালা এক দারোগার নেতৃত্বে কয়েকজন সিপাহি এসে রাইফেল কাঁধে মেলার ভিতর ঘুরতে থাকে । 
কয়েকটা টেলিভিশন চ্যানেল একসাথে প্রচার করে নরিম করিমের সাক্ষাৎকার যা তাদের দুই ভাইকে উঠিয়ে আনে সেলিব্রেটির মর্যাদায় এবং মেলা তাদের দুই ভায়ের মাঝের ঝগড়া কলহ ঝেঁটিয়ে বিদায় করে। দেয়াল যেহেতু এখন আর ভাংগা সম্ভব না সেহেতু তারা দুই বাড়িতে যাতায়াতের জন্য দেয়ালের তল খুঁড়ে একটা সরল সুড়ঙ্গ বানায়। এখন তারা দোকনে যায় না, রোগীও দেখে না। ভোরে গোসল করে পাজামা-পাঞ্জাবির উপর শেরওয়ানি কিস্তি টুপি পরে নরিমের উঠানে খাটে পাতা লাল মখমলের চাদরের উপর বসে। তাদের ঘিরে থাকে কয়েকজন উদ্যোগী ভলেন্টিয়ার। 
দূর দূর এলাকা থেকে মেলায় আসা মানুষেরা এটা ওটা কেনে, দেয়াল দেখে, নিমগাছ দেখে, বায়স্কোপ, সার্কাস দেখে,হোটেলে খায়, কেউ কেউ পুতুল নাচ, ভ্যারাইটি শো দেখে, সারারাত যাত্রাপালা দেখে, এসবের মাঝে এক ফাঁকে এসে নরিম করিমকে সালাম জানিয়ে পরিচিত হয়, কেউ কেউ মোবাইল ফোনে তাদের সাথে ছবি তোলে। 
তারা দেয়ালের কাছে আসে এক অজ্ঞাত ভক্তিসহ। অনেকেই দেয়ালের ভিতরে অতিপ্রাকৃত কিছু আবিষ্কার করে আর তার বিশালতা এবং উ"চতার মাঝে খুঁজে পায় স্রষ্টার নিদর্শণ। প্রচারিত হয়ে যায় এই দেয়ালের উপরে কোনো পাখি বসে না, এমনকি দেয়ালের উপর দিয়ে কোনো পাখি ওড়েও না। 
মেলা পরিচালনা কমিটির লোকেরা মেলায় প্রত্যেক দোকান, হকার, সার্কাস, যাত্রাদল, পুতুল নাচ, ভ্যারাইটি শো সবার কাছ থেকে প্রতিদিন টাকা নেয়। গভীর রাতে মেয়র  ক্যাশিয়ার চৌকিদারসহ মেলায় আসে। মেলা পরিচালনা কমিটির টিনের ছাবড়ার অফিসে বসে। মেলা থেকে আদায় করা টাকার হিসাব নেয়। মেলা পরিচালনা কমিটির যারা কাজ করে তাদের খরচ দেয় আর নরিম করিমকে দেয় আদায় হওয়া টাকার দশ + দশ = বিশ পার্সেন্ট। বাকি টাকা মেয়র ক্যাশিয়ারের কাছে জমা রাখে। এই ব্যবস্থায় সবাই খুশি।
হঠাৎ কালো গ্লাস লাগলো একখানা চকচকা গাড়ি আসে মেলার মাঠে। গাড়ি থেকে নামে গরমের দিনে কোট প্যান্ট টাই পরা দু’জন লোক। মুহূর্তে এই লোক দু’জনকে ঘিরে মেলা পরিচালনা কমিটির লোকজনের মাঝে প্রবল কৌতূহল জেগে ওঠে। লোক দু’জনের দিকে কয়েকজন ভলেন্টিয়ার এগিয়ে সালাম দিয়ে সামনে দাঁড়ায়। লোক দু’জন তাদের সামনে দাঁড়ানো ভলেন্টিয়ারদের দিকে চরম তাচ্ছিল্যে তাকিয়ে বলে ‘উনারা দুই ভাই কোথায়?’ 
ভলেন্টিয়ারদের একজন আনুগত্যে নুয়ে বলে ‘আসেন ছার আমার সাথে আসেন, ওরা বাড়ির ভিতরে আছে।’ 
লোক দু’জন ভলেন্টিয়ারদের পিছন পিছন নরিমের বাড়ি আসে। নরিম করিম খাট থেকে নেমে লোক দু’জনকে সালাম দেয়। একজন ভলেন্টিয়ার বলে ‘ছার এই যে এরা দুই ভাই, এরাই দেয়াল বানাইছে।’ 
লোক দু’জন হাসিমুখে নরিম করিমের সালামের জবাব দেয়। হাত বাড়িয়ে তাদের হাত ধরে আর ভলেন্টিয়ারদের দিকে তাকিয়ে বলে ‘আমরা শুধু ইনাদের সাথে কথা বলতে চাই।’ ভলেন্টিয়ার দু’জন নরিমের বাড়ি থেকে বাইরে এসে দাঁড়িয়ে চরম আগ্রহে উঁকি দিতে থাকে ভেতরে।
লোক দু’জনের একজন বলে ‘আমি ফাইয়াজুর রহমান, আমরা আসছি শরীরের রং ফর্সা করা ক্রিম প্রস্তুতকারী লাল্টু কোম্পানি থেকে। আমরা চাইছি দেয়ালেরর উপরের দিকে কিছুটা জায়গা যেখানে আমাদের কোম্পানির বিজ্ঞাপন দিবো অবশ্য তার জন্য আপনাদের টাকা দিবো। আপনারা রাজি থাকলে এখনই আমরা আপনাদের সাথে চুক্তি করে ফেলতে পারি,আপনাদের টাকার চেকটাও দিয়ে দিতে পারি, আপনরা বলুন, বিশ বাই ত্রিশ ফিট  জায়গার জন্য আপনারা কতো টাকা চান বছরে?’ 
নরিম করিম একজন আর একজনের মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল তাকিয়ে থাকে। তারা একজন সাধারণ মানুষের কথা শুনে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখেই বলে দিতে পারে অসুখের খবর কিন্তু তারা কোট প্যান্ট টাই পরে গাড়িতে ঘোরা এইসব মানুষের কথা শুনেও কিছু বুঝতে পারে না! দুই ভাইয়ের  নীরবতা দেখে লোক দু’জনের একজন বলে ‘বলুন কতো টাকা চাই আপনাদের?’ 
নরিম বলে ‘দ্যাখেন ছার এই মেলা চোলতিছে মেয়র সাহেবের মাতব্বরিতে। তিনার কাছে না শুনে আমরা কিছু কোতি পারবো না।’ 
‘এটা কোনো কথা হলো ভাই সাহেব? দেয়াল আপনাদের মেয়র এখানে কী বলবে? আপনারা আমাদের সাথে চুক্তি করে টাকা নিন তারপর আমরা করবো যা করার।’ 
‘তা হয় না ছার, মেয়র সাহেবের সাথে কথা না কোয়ে আমরা আপনাগে কিছু কোতি পারবো না। কিসিরতে কী হয়ে যাবে আর নানান ফ্যাসাদ আইসে আমাগে দুয়োরে খাড়া হবে, আমরা নিরীহ গরিব মানুষ ওসব ফ্যাসাদ আমরা সামলাতি পারবো না। রাতে মেয়র সাহেবের কাছে শুনি তারপর আপনাগে জানাবো।’ 
‘বেশ আমরা যাচ্ছি, এখন আমাদের প্রস্তাবে রাজি হলে আপনাদেরই লাভ হতো। এখানে আমরা বাজারের ওইদিক থেকে বিদ্যুৎ লাইন আনবো, আপনারা চাইলে আরও অনেক কিছু হতে পারে। এখানে সিনেমার নায়িকা আসবে, তারা নাচবে গাইবে ব্রান্ডিং করবে লাল্টু ফেস ওয়াশ, লাল্টু হারবাল ক্রিম, লাল্টু লোমনাশক ক্রিম, লাল্টু কোল্ড ক্রিম আরও যা যা লাল্টু কোম্পানির উৎপাদিত পণ্য। আমরা আসবো  কিন্তু তখন হয়তো আপনারা কিছুই পাবেন না।’ নরিম করিম তাদের কথার মানে খুঁজে পায় না, তাদের ধারণা হয় লোক দু’জন নিজেদের মাঝে কথা বলছে। তারা দুই ভাই গম্ভীর মুখে ভয়ে ভাবনায় মুষড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। লোক দু’জন তাদের সাথে হাসি মুখে হাত মিলিয়ে চলে যায়। 
রাতে মেয়র এসে নরিম করিমকে গোপনে ডেকে বলে ‘সকালে কোম্পানির লোকেরা আসবে, তারা দেয়ালে একটা ছবি টানাবে, বিদ্যুতের লোকেরা আসবে বিদ্যুতের লাইন লাগাবে। আমার সাথে সবার কথা হয়েছে। ঠিকাছে সমস্যা নাই। তারা কিছু টাকা দিয়েছে তার থেকে তোমাদের কিছু দিচ্ছি বাকিটা খরচ খরচা লাগবে। এ বিষয়ে তোমরা কারও সাথে কোনো কথা বলবে না। কেউ কিছু বললে বলবে ওসব মেলা পরিচালনা কমিটির সভাপতি জানে। ঠিক আছে?’ 
‘জ্বী’
মেয়র নরিম করিমের দিকে বিশ হাজার টাকার একাটা তোড়া এগিয়ে দিয়ে বলে ‘নাও এগুলো দুইভাই ভাগ করে নাও। ঝামেলা বাধিও না নিজেদের মাঝে।’ 
নরিম করিম কিছু বলে না। তারা খুব খুশি। কারণ অচেনা সাহেবদের কথা শুনে তাদের যে ভয় হয়েছিলো মেয়র তার সাথে যোগ হয়ে সব কিছু নিজের কাঁধে তুলে নেয়াতে তাদের ভয় দূর হয়ে যায় তার উপরে মেয়রের দেয়া একশ টাকার নোটগুলো তাদের প্রফুল্ল করে তোলে। 
পর সকালে মিনি ট্রাকে মালপত্র নিয়ে দেয়ালের কাছে আসে লাল্টু কোম্পানির টেকনিশিয়ানরা। তারা তাদের ঘিরে থাকা অবাক লোকজনের সামনে লোহার এঙ্গেল জুড়ে জুড়ে একটা বিশাল মই তৈরি করে দেয়ালের গায়ে। মই বেয়ে দ’ুজন তর তর  উঠে যায় অনেক উপরে। সেখানে শিরিষ কাগজ ঘষে দেয়ালের কিছু অংশ পরিষ্কার করে আর দড়ি বেঁধে টেনে তোলে প্যানাফ্লেক্সের একটা বান্ডিল। তারপর প্যানাফ্লেক্সের বান্ডিলের প্যাঁচ খুলে আঠা দিয়ে লাগিয়ে দেয় দেয়ালে। সাথে সাথে  দৃশ্যমান হয়ে ওঠে এক সুন্দরি যুবতি, কাঁধসহ বুকের অর্ধেক আর পেট পুরোটাই উলঙ্গ, জিন্সের এক চিলতে হাফ প্যান্ট পরে মাংসল ফর্সা উরু বের করে হাসিমুখে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে। তার বাড়ানো ডান হাতে ধরা লিঙ্গাকৃতির গোলাপি মুখওয়ালা একটা ক্রিমের টিউব, পাশে জ্বল জ্বল হলুদ অক্ষরে লেখা ‘মাত্র এক সপ্তাহ লাল্টু হারবাল ক্রিম ব্যবহারে আপনার ত্বক হবে ফর্সা উজ্জ্বল সতেজ’। 
মেলায় উপস্থিত লোকজন অবাক তাকিয়ে থাকে বিজ্ঞাপনের মেয়ে মানুষের দিকে। দেয়ালের আগে সবার চোখ আটকে যায় ন্যাংটা মেয়ে মানুষের ছবিতে। 
সন্ধ্যা নাগাদ বিদ্যুৎ বিভাগ মেলায় বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়। দেয়ালে লাল্টু কোম্পানির বিজ্ঞাপনের উপরে সরাসরি আলো পড়ে শক্তিশালি হ্যালোজেন বাতির। 
বিজ্ঞাপনের নারী দেওয়াল আড়াল করে আলোয় ঝলমল, রাতের অন্ধকারে আকাশের গায়ে তীব্র আলোয় লাল্টু ক্রিমের টিউব উর্ধ্বে তুলে পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে ফর্সা, স্বাস্থ্যবতী, যৌন মিলনের আকাক্সক্ষায় কাতর আহ্বানের ভঙ্গিতে অর্ধউলঙ্গ যুবতি। লোকজন সব ভুলে বুভূক্ষ চোখে দেখে বিজ্ঞাপনের নারীর বুকের, নিতম্বের, উরুর, পেট আর নাভীর বাহার, কাতর ঘুম ঘুম চোখ ভেঁজা ভেঁজা ঠোঁটের চাপা রহস্যময় হাসি। লোকেরা দেখে, নিজেদের ঠোঁট চাটে, বড় বড় শোকের নিঃশ্বাস ছাড়ে আর তাদের বাড়ির কঠোর শ্রম-অযত্ন-পুষ্টিহীনতা-অনটনে কাহিল,ঝিমিয়েপড়া রসকসহীন বিষাদময় শোকগ্রস্থ গম্ভীর মুখের মেয়ে মানুষের তুলনা করতে গিয়ে হাফিয়ে ওঠে।
পর সকালে একের পর এক দামি গাড়িতে চেপে কোট টাই পরা মানুষ নরিম করিমের কাছে আসতেই থাকে। তাদের কেউ ফোন কোম্পানির, কেউ গায়ে মাখা সাবান, কেউ যৌনশক্তি বর্ধক মালিশ আর সিরাপ,  আইসক্রীম, মটরসাইকেল, প্যান্টি-ব্রা, নারকোল তেল, উকুননাশক শ্যাম্পু, স্যানিটারি ন্যাপকিন, চানাচুর, হজ্ব এজেন্সি ইত্যাদি সব কোম্পানির প্রতিনিধি। তারা এসে নরিম করিমের কাছে দেয়ালের বিজ্ঞাপন লাগানোর অনুমতি চায়। নরিম করিম তাদের মেয়রের কাছে যেতে বলে।
রাতে মেয়র নরিম করিমকে ডেকে গোপনে বলে ‘দুই ভাই এতোদিন নিজেদের মাঝে ঝগড়াঝাটি করেছো তাতে তোমাদের কোনো লাভ হয়নি, মূলত কলহে কোনো লাভ হয় না, মিলনেই শান্তি। এখন আমি তোমাদের কিছু টাকা পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি, মুখ বন্ধ করে থাকবা, যেখানে যা করার আমিই করবো, বহু ঝামেলা আছে সব সামলানোর জন্য পয়সা কড়ি খরচ হচ্ছে। এসব কাজ তো তোমাদের মতো জঙ্গল থেকে বিনা পয়সায় গাছ-গাছড়া তুলে এনে কবিরাজি করা না, মানুষ নিয়ে কারবার, অনেক মত-পথ-স্বভাবের মানুষ সবাইকে সামলাতে হচ্ছে। তোমরা চুপ করে থাকবা, নাও এই প্যাকেটটা রাখো এর ভিতরে চার লাখ টাকা আছে দুই ভাই ভাগ করে নিবা। সকালে কোম্পানির লোকেরা আসবে, আমিও আসবো তাদের বিজ্ঞাপনের জায়গা দেখিয়ে দিতে হবে। দেখি তোমাদের দুই ভাইকে মেডেল পাওয়ায় দিবানে। এখন যাও।’ 
নরিম করিম টাকা পেয়ে মহাখুশি কিন্তু মেডেলের কথা তাদের একটু ঘাবড়ে দেয়। তারা শুনেছে তাদের দাদা সুরমান কবিরাজ একবার মেডেল পেতে পেতেও কোনো এক কাদেরের ষড়যন্ত্রের কারণে পায় নাই। নরিম করিমকে জিজ্ঞেস করে ‘হ্যারে ভাইডি, মেডেল পালি কি হয়?’ 
করিম অবাক হয়ে বলে ‘আমি তা কি অরে কবো?’
‘ঠিক আছে চুপ করে থাকপি, টাকা পয়সা বেশি খরচ করবিনে, বেশি বেকায়দা দেখলি পলান দিবানে, মামুগে দ্যাশে পদ্মার ওইপারে চলে যাবানে। জানের বড় কিছু নেই।’ 
‘হ ঠিক বুদ্ধি হোইছে, তয় আমরাতো কোনো অন্যায় কোরিনি, তুমি খালি খালি ভয় পাতিছো, মেয়র আমাগে সাথে আছে, আমাগে ভয় পাওয়ার কারণ নেই।’ 
‘মেয়ররে নিয়েইতো আমার ভয়,ও কতো কামাচ্ছে তা আল্লা আর ও নিজি কোতি পারে, আমাগে তো ছিটে ফুটা দেয়।’ 
‘এই ছিটেফুটাও আমাগে জন্যি অনেক। কিছুই তো পাতাম না, যা পাচ্ছি তাই নিয়ে খুশি হও বেশি লোভ কইরে না, মেয়র না থাকলি কি ম্যালারতে এক টাকাও আমরা পাতাম? পাতাম না।’ 
পর সকালে মতিখালি গ্রামে একের পর এক গাড়ি আসে তার থেকে নামে মালপত্র, লোকজন। মেয়র দাঁড়িয়ে থেকে লিস্ট ধরে পুরা দেয়ালে এক এক কোম্পানির লোকদের তাদের বিজ্ঞাপন লাগাবার জায়গা দেখিয়ে দেয়। দুপুরের ভিতরেই বিভিন্ন কোম্পানির পণ্যের বিজ্ঞাপনে সারা দেয়াল ঢেকে যায়। ছোট বড় নানান মাপের বিজ্ঞাপনে প্রায় উলঙ্গ কামকাতর ভঙ্গির মেয়ে মানুষের ছবি আছেই, হোক সে সাইকেল, দাঁতের মাজন বা মেশিন টুলস। 
দূর দূর এলাকা থেকে দলে দলে মানুষেরা আসে আশ্চর্য দেয়াল আর মেলা দেখতে। তারা হা করে তাকিয়ে থাকে বিজ্ঞাপনের মেয়ে মানুষের দিকে, দেয়াল খুঁজে পায় না। মেয়ে মানুষের ছবি দেখেই তারা বহুত খুশি। তারা ঘুরে ঘুরে মেলা দেখে, ভ্যারাইটি শোতে নাচগান দেখে, সার্কাসে দড়িতে দোল খাওয়া আর বাঘের পিঠে ব্রা-পেন্টি পরা মেয়ে মানুষ দেখে, ফুসকা খায়, শিক কাবাব পরাটা খায়, চরকা আর গুটি খেলায় ভাগ্য পরীক্ষা করে। আপদবালাই বদজ্বেন শয়তানের আছর থেকে মুক্তি পাবার জন্য বারো চান্দের তাবিজ কিনে গলায় পরে। যাত্রার স্টেজে দেখে বারোআনা ন্যাংটা মেয়ে মানুষের শরীর ঝাকানো। দেয়ালের জায়গায় দেয়াল দাঁড়িয়ে থাকে বিজ্ঞাপন মুড়ি দিয়ে। মেয়রের লোকজন দোকানপাট থেকে খাজনা আদায় করে, নরিম করিমের জমির সাথে আরও কয়েকজনের জমিতেও মেলা প্রসারিত হয়ে প্রতিদিন নতুন নতুন দোকানপাট এসে বসে।  
হঠাৎ ঘনিভুত হয়ে প্রসারিত হতে থাকা মেলা কতোদিন চলবে তা কেউ বলতে পারে না কিন্তু একটা বিষয় পরিষ্কার যারা স্বতস্ফূর্তভাবে মেলার প্রথম দিকে ভাজা, ফুলরি, বেগুনি, তালপাখা, বেলুন, বাশের বাঁশি, মাটির খেলনা ইত্যাদির দোকান দিয়ে মেলা শুরু করেছিলো আজ তাদের জায়গা দখল করেছে ঘাঘু ব্যাবসায়ীরা। 
মতিখালি হাট এই কয়দিনে মৃত্যুর খুব বিপদজনক কাছে পৌঁছে গেছে। হাটের দিনে যেখানে মানুষের পা ফেলার জায়গা থাকতো না সেখানে হাটবারে কিছু ধানপাটের ব্যাপারী আর দু’একজন মাছ তরকারি বিক্রেতা-ক্রেতা ছাড়া কাউকে দেখা যায় না। এখন মেলার উত্তরপাশেই মাছ তরকারির দোকান বসে, এখানেই জমে উঠেছে  বাজার। 
পাকা ব্যবসায়ীরা তাদের অভিজ্ঞ কানে শুনতে পায় মতিখালি বাজারের মৃত্যুর কাতরানি। তারা তিন নম্বর চোখে দেখে দেয়াল কে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠছে আধুনিক বাজার। দূরদর্শী কোনো কোনো ব্যবসায়ী মেলার সাথে জমি কেনার জন্য খোঁজ-খবর করতে থাকে। তারা অনুভব করে পৃথিবীতে মানুষের কৌতুহলের শেষ কোনোদিন হবে না কাজেই এখানে মানুষের আসাও কোনোদিন বন্ধ হবে না বরং এখন থেকে আরও বাড়বে আর যে কোনো উপলক্ষে মানুষেরা এক জায়গায় জড় হওয়া মানেই সেখানে মালপত্র বেচাবিক্রি চালু হয়ে জারি থাকবে...
পর সকালে নরিম করিমকে মেয়র লোক পাঠিয়ে ডেকে নেয় তার বাড়িতে। তারা গেলে তাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে কৌতুক মেশানো কণ্ঠে বলে ‘তোমরা দুই ভাই নিজেদের মাঝে হিংসা হিংসি করে এলাকায় এক ফ্যাসাদের দেয়াল তুলেছো আর সেই দেয়ালের তলা দিয়ে এক শান্তির সুড়ঙ্গ খুঁড়ে দুইভাই মিলেমিশে গলাগলি ধরে বসে বসে কড়কড়ে টাকা পাচ্ছো। প্রতিদিন নতুন নতুন ফ্যাসাদ তৈরি হচ্ছে তোমাদের এই শান্তির ভিতর দিয়ে যা সামলাতে আমার জীবন অতিষ্ট। শোনো ভালো করে সামনের শনিবার, আজ হচ্ছে বুধবার মানে আজ থেকে দিন পর এই মেলায় মন্ত্রী, এমপি আর সিনেমার নায়িকা আসবে। মন্ত্রী এমপি বক্তব্য দেবে নায়িকা নাচবে লাল্টু ক্রিমের গুনগান করবে। 
সে জন্য স্টেজ বানাতে হবে, সাউন্ড আনতে হবে অদ্ভূত ব্যাপার মানুষের নিজস্ব শব্দে পেশায় না তাই উ"চ শব্দ করার জন্য যন্ত্র বানিয়েছে। স্টেজ সাউন্ড ডেকোরেটর চেয়ার টেবিল সামিয়ানা ব্যানার ফেস্টুন লাইট এসব বহু টাকা আর ঝামেলার ব্যাপার। যা হোক ওই অনুষ্ঠানে তোমদের দুই ভাইকেও থাকতে হবে স্টেজে। মন্ত্রী তোমাদের গলায় মেডেল পরাবে। তোমাদের দু’চার কথা বলতে হবে। কি বলবা তোমরা ?’ 
‘আপনি যা কোতি কবেন আমরা তাই কবো।’ 
‘মাইকে যখন তোমদের নাম ঘোষণা করবে বলার জন্য। তখন মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমে সভাপতি মাননীয় মন্ত্রী এমপি মঞ্চে বসা অন্যান্য সবাই এবং উপস্থিত দেশবাসীদের সালাম জানাবা তারপর বলবা এই দেয়াল বানানোর জন্য তোমরা অনেক কষ্ট করেছো কিন্তু এই সব আয়োজন করেছেন মেয়র সাহেব আর তিনিই সব কিছু সামলাচ্ছেন, তিনি আমাদের সুখ দুঃখের কা-ারি, তিনার মুখ থেকেই আপনারা সব কথা শুনছেন, শুনবেন  তারপর সবাইকে সালাম দিয়ে বক্তব্য শেষ করবা। ঠিকাছে এর বেশি বা কম বলবা না, যদি বলতে যাও তবে সবকিছু গুলিয়ে ঝামেলা তৈরি হবে। ঠিকাছে? ভয় পাবার কিছু নেই স্টেজের সভাপতিতো আমিই থাকবো। এই কাগজটা রাখো এই কাগজে তোমাদের বক্তব্য লেখা আছে দুই ভাই ভালো করে মুখস্থ করবা আর পরিষ্কার জামা কাপড় পরে স্টেজে আসবা, ভালো জামাকাপড় আছে না?’ 
‘জ্বী আছে।’ 
‘যাও একটু পরে মিস্ত্রি আসবে তাদের সাথে স্টেজ বানানোর বিষয়ে কথা বলতে হবে’ একটা জুস কোম্পানি স্টেজ আর সাউন্ডের জন্য টাকা দিতে চেয়েছে। দেখি তাদের বলে তোমাদের জন্য কিছু টাকার ব্যবস্থা করতে কি না, এখন যাও, একদম মুখ বন্ধ করে থাকবা, কাউকেই বলবে না কোনো কথা। ঠিকাছে? যাও।’  
নরিম করিম বুঝতে পারে না জুস কোম্পানি স্টেজ আর সাউন্ডের খরচ দিবে তার উপরে কেনই বা তাদের টাকা দিবে? এসব ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের বিজ্ঞাপন ব্যবস্থাপনার কিছুই তারা জানে না। তারা পাঁচ হাজার টাকা পেলেই মহাখুশি, টাকা না পেলেও খুশি এই কারণে যে, তাদের কোনো ঝামেলায় জড়াতে হয়নি।
মতিখালি এলাকার জমির দাম হু হু বাড়তে থাকে। অনেক অচেনা সাহেব শ্রেণির লোকেরা এসে জমি কিনতে চায় নদীর তীর ঘেঁষে দেয়ালের কাছাকাছি। তাদের কাছে জমির দাম কোনো ব্যাপার না। জমির মালিকেরা জমির যে দামই চায় তারা সে দামই দিতে রাজি হয়ে যায়, আর দ্রুত বায়না করে ফেলে। 
হঠাৎ খুব ফিটফাট তিনজন সুদর্শণ মানুষ বিশাল ঝকঝকে জিপে নরিম করিমের বাড়িতে আসে। তারা নরিম করিমকে ডেকে গাড়িতে তোলে, জানালা দরজা বন্ধ গাড়ির মধ্যে দুই ভাইকে বসিয়ে তিনজনের একজন বলে ‘আমরা রাজধানী থেকে আসছি আপনাদের সাথে কথা বলার জন্য।  আগেই বলে রাখি আমরা ব্যবসায়ী কোনো চিটার বাটপার দালাল নই। এখানে  যা যা হচ্ছে এবং আগামীতে যা হবে তার প্রায় সবই আমাদের জানা। প্রথমত এখানে প্রতিদিন যে টাকা আয় হচ্ছে তার খুব সামান্য অংশ আপনাদের দেয়া হচ্ছে। গড়ে প্রতিদিন আয় হচ্ছে আট থেকে দশ লক্ষ টাকা আপনাদের কতো দিচ্ছে মেয়র? দশ থেকে বিশ হাজার তার বেশি না। দ্বিতীয়ত দেয়ালে যে সব বিজ্ঞাপন লাগানো হয়েছে তাদের কাছ থেকে মেয়র সব মিলিয়ে পেয়েছে ছয় থেকে সাত কোটি টাকা আপনাদের কতো দিয়েছে? খুব বেশি হলে চার থেকে পাঁচ লাখ, অথচ জমি এবং দেয়াল আপনাদের  তার থেকে যা আয় হচ্ছে তার প্রায় কিছুই আপনারা পাচ্ছেন না। এখন এখানে যে অবস্থা তার নিয়ন্ত্রণ করা আপনাদের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব না। একটা কথা শুনে রাখুন এই দেয়াল আর মেলার কারণে খুব কম সময়ের মধ্যে আপনাদের জীবনে খুব বড় ধরনের বিপদ আসছে, যে বিপদ আপনারা সামলাতে পারবেন না। এমনকি আপনাদের খুন করার চেষ্টাও করা হতে পারে আর সে চেষ্টা সফল না হবার কোনো সম্ভাবনা নাই। আমরা ব্যবসায়ী কোনো দস্যু বা খুনি নই, কোনো ধান্দাবাজ চিটারও নই, আমরা আপনাদের জন্য একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। এখানে আপনাদের মোট জমির দাম কত হবে ধরুণ সব মিলিয়ে খুব বেশি হলে দশ লক্ষ টাকা। আপনাদের বাড়িঘর, গাছগাছালি মিলিয়ে ধরুন তিন লাখ, তাহলে তের লাখ, দেয়ালের খরচ ধরুন ত্রিশলক্ষ যদিও তা হয়নি। তাহলে তের আর ত্রিশ তেতাল্লিশ লক্ষ টাকা, এখন জমির দাম একটু বেড়েছে সেই হিসাবে এর সাথে যোগ করুন আর পাঁচ তাহলে মোট আটচল্লিশ, আচ্ছা আপনি পঞ্চাশ লক্ষই ধরুন। আমরা আপনাদের দুই ভাইকে দুই কোটি টাকা দিচ্ছি। জমির রেজিস্ট্রি খরচ আমাদের। আপনারা রেজিস্ট্রি অফিসে যাবেন, দলিলে স্বাক্ষর করবেন আর টাকা নিবেন, কোনো ভায়া মিডিয়া নেই। এক কোটি টাকা ব্যাংকে রাখলে মাসে এক লাখ করে পাবেন। আপনাদের আশপাশের গ্রামে জমির দাম বিঘা প্রতি বিশ থেকে পচিশ হাজার টাকা। একখ- জমি কিনে বাড়িঘর বানিয়ে দুই ভাই সারাজীবন সুখে শান্তিতে কাটাবেন। নিশ্চয় সেই জমি কিনে বাড়ি করবার টাকা ইতিমধ্যেই আপনারা পেয়েছেন মেয়রের কাছ থেকে। যা হোক বলুন, আমাদের প্রস্তাবে আপনারা রাজী?’ 
নরিম করিমের সারা শরীর কাঁপতে থাকে, গলা বুক শুকিয়ে আসে, তারা তীব্র পানি শূন্যতায় ধুকতে ধুকতে  বলে ‘ছার আমরা দুই ভাই একটু চিন্তা ভাবনা করে তারপর আপনাগে জানাবানে।’ 
‘সমস্যা নাই, দুই চারদিন পরেই আমাদের জানান, তবে আপনারা চোখ কান খোলা রেখে সাবধানে চলাফেরা করবেন। আপনারা চাইলেই এখন এই জমি প্রকাশ্যে বিক্রি করতে পারবেন না। ঝামেলা হয়ে যাবে। আমাদের সাথে আপনারা কারবার করলে আপনাদের যে কোনো ঝামেলা আমরা সামলাবো। আপনারা চাইলে আপনাদের টাকা আমরা সেভ করে দিবো। জমি বিক্রি করে এখানথেকে চলে গেলে কেউ আর আপনাদের খুঁজবে না। এখানে মন্ত্রী আসবে শনিবারে। আমরা আপনাদের সাথে যোগাযোগ করবো বুধবার যদি আপনারা আমাদের প্রস্তাবে রাজি হন তারপর আমরা পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে এগোবো। এখন আপনারা গাড়ির ভিতর থেকে বের হবার পর বাইরের লোকজন জিজ্ঞেস করবে আমরা কারা, কী জন্য এসেছি, আমাদের সাথে আপনাদের কী কথা হলো? আপনারা বলবেন মন্ত্রী আসবে কোথায় কী হবে এইসব নিয়ে আমরা কথা বলেছি। এখোন  যান ভাবনা চিন্তা করুন পরে আমরা আপনাদের সাথে যোগাযোগ করবো।’ তাদের একজন গাড়ির দরজা খুলে বলে ‘সাবধানে থাকবেন।’ 
গাড়ি থেকে বের হওয়া মাত্র কয়েকজন ভলেন্টিয়ার নরিম করিমকে ঘিরে দাঁড়ায় আর জিজ্ঞেস করে ‘উনারা কারা, কী কয় ?’
নরিম বলে ‘মন্ত্রী আসপে, এসটেজ হবে, মাইক আসবে, কুথায় কী হবে এইসব কলো।’
‘আর কি কলো?’
‘এই সবই তো কলো।’
‘উনারা কারা?’
‘তা কোতি পারিনে, তুমরা তো দেহিছো উনারা সাহেব।’ 
‘কুথারতে আইছে?’
‘টাউনিরতে।’ 
বিশাল বড় আর উঁচু স্টেজ তৈরি হয়। সন্ধ্যার অল্প আগে ট্রাকভরা সাউন্ড বক্স, যন্ত্রপাতি আসে। রঙিন ব্যানার, ফেস্টুন, লাল নীল বিজলি বাতির আলোয় ঝলমল করতে থাকে মেলা। যাত্রার নাচনেওয়ালী শরীর ঝাকিয়ে গায় উত্তাল বাজনার তালে ‘সাইয়া দিলমে আনারে .... হায়, দিলমে কাটা...
সব কিছু মিলে সারা এলাকার মানুষদের মাতাল করে তোলে, মেলায় উপস্থিত সবাই উতল অস্থির  অপেক্ষা করে কোনো এক চরম ঘটনার জন্য, যার সম্পর্কে তারা কিছুই জানে না অথচ তা না ঘটা পর্যন্ত তাদের উৎকণ্ঠা আর অস্থিরতার  নিস্তার নেই। 
মেয়র একদল লোক সাথে নিয়ে মেলার ভিতর দিয়ে দাপিয়ে বেড়ায়, ঘুরপাক খায়, দেখে শুনে ভলেন্টিয়ারদের নির্দেশ দেয়। 
নরিম করিম কোনো এক অজ্ঞাত ভয়ে আত্মহারা, মুহ্যমান। জমি কিনতে আসা সাহেবরা বলেছে যে কোনো মুহূর্তে বিপদ আসবে। তারা বুঝতে পারে না কি বিপদ, কোথা থেকে, কখোন আসবে? বুঝতে না পারার প্রেসারেই তারা বেশি আতংকিত হয়। ঘটনাটা তারা কাউকে বলতেও পারে না! 
করিম বলে নরিমকে ‘চলোদি ভাই এহেনির জমিজমা বেচে দিয়ে পলান দেই, জানের বড় কিছু নেই। আমরা মামুবাড়ি চলে যাই। আমাগে মোকলেসওতো সরকারি দলের নেতা, তারও দলবল আছে তার কাছে চলে গিলি কেউ আর আমাগে কিছু কোরতি পারবে না। সে তো আমাগে আপন মামাতো ভাই তার উপর মহলে লোকজন আছে।’ 
নরিম বলে ‘ভালো কথা মোনে করিছিস, এক কাজ কর মোকলেসরে ফোন কর, তারে এহেনি আসতি ক, তারে সব ভাইঙ্গে কোতি হবে, তারপর দেহি সে কি কয়? ফোন কর, নম্বর আছে না তার?’
‘হ আছে।’ 
করিম মোকলেসকে ফোন করে আর এদিকে যা যা হচ্ছে সেটা মোটামুটি গুছিয়ে বলে, মোকলেস বলে ‘ভয়ের কোনো কারণ নাই,আমি আগামী পরশু আসতিছি,তুমাদের ওখানে আমাদের লোকজন আছে, আমি ফোনে সব যোগাযোগ করে রাখতিছি, এসে দেখবো কী করলি ভালো হয়।’
শনিবার সকাল থেকে মেলায় এত মানুষ জমা হয় যা মতিখালি কেনো জেলা শহরেও কেনো অনুষ্ঠানে কোনো দিন হয়নি। আশপাশের সব গ্রামের মানুষ ছাড়াও জেলা শহর এবং দূর দূরান্ত থেকে নায়িকা আসবে শুনে দলে দলে নারী পুরুষ আসতে থাকে। 
 এ দিন সকাল হবার সাথেই মেলার দোকানপাট সব চালু হয়ে যায়। সার্কাসের বাজনা, ভ্যারাইটি শোর উদ্দাম ড্রামের সুর মাইকের গান হাজার হাজার মানুষের চিৎকার, কোলাহল মিলিয়ে এক মহা শোরগোল পাক খেতে থাকে, বেলা বাড়ার সাথে সাথে যা আরও প্রবল হয়ে ফুঁসতে ওঠে... 
স্টেজ ঘিরে রেখেছে একদল দাঙ্গা পুলিশ, স্টেজের সামনে চারপাশ ঘেরা উপরে সামিয়ানা টানানো বিশাল প্যান্ডেলের ভিতরে সারি সারি চেয়ারে অজস্র নারী পুরুষ অধীর আগ্রহে বসে বসে ঘামে। স্টেজের দুই পাশে সাজানো দশ বারো পিয়ার বিশাল বিশাল সাউন্ড বক্স থেকে বের হচ্ছে ‘দিলডা ফাইট্ট্যা যায়...’ যার ভয়ংকর তোড়ের সামনে চাপা পড়ে গেছে অন্য সব শব্দ... 
মানুষের অস্বস্তিকর অপেক্ষার ইতি টেনে বারোটার কয়েক মিনিট আগে মন্ত্রী এমপি আর স্থানীয় প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গাড়িতে করে মেলায় আসে। ঘন ঘন পুলিশের বাঁশি বাজে। জনগণ কৌতুহলের চূড়ান্তে দাঁড়িয়ে একজন আর একজনের সাথে ঠেলাঠেলি করে কি হচ্ছে দেখতে চেষ্টা করে। তাদের আগ্রহ এমন যেন মন্ত্রী এমপিকে দেখতে না পারলে তাদের এক্ষুণি মৃত্যু হবে। 
পুলিশের দল বাঁশি বাজিয়ে লাঠি উঁচু করে তাড়িয়ে লোকজনের মাঝে একটা পথ তৈরি করে, সে পথেই এগিয়ে আসে মন্ত্রীর গাড়ি বহর, স্টেজের পিছনে এসে গাড়ি থামে। মন্ত্রী এমপির সাথে আরও কয়েকজন গাড়ি থেকে নামে। মেয়র ফছিয়ার রহমান কয়েকজন ভলেন্টিয়ারসহ মন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানায়। 
মাইক্রোফোনে এই এলাকার মানুষের অচেনা এক যুবক সম্ভবত তাকে ভাড়া করা হয়েছে অনুষ্ঠানের জন্য। সে পরিষ্কার ভরাট কণ্ঠে বলে ‘মন্ত্রী মহোদয়ের আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম, এমপি মহোদয়ের আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম। উপস্থিত বন্ধুগণ আপনারা চুপচাপ বসে পড়–ন, আমাদের মাঝে মাননীয় মন্ত্রী জননেতা আজগার আলী কুট্টি এসে উপস্থিত হয়েছেন সেই সাথে এই এলাকার গণমানুষের নেতা শেখ ফায়েকুর রহমান ফায়েক এমপি উপস্থিত আছেন, অত্র এলাকার আশা ভরসার প্রতীক সুযোগ্য মেয়র ফসিয়ার রহমান ফসি ভাই আছেন আমাদের মাঝে। 
মন্ত্রী, এমপি, মন্ত্রী আর এমপির পিএসকে সাথে নিয়ে মেয়র সরাসরি স্টেজে উঠে আসে, তাদের সাথে অন্যরা বসে স্টেজের সামনে সাজানো সোফায়। 
স্টেজে সাদা চাদরে ঢাকা টেবিলের এ পাশে সাজানো কুশন চেয়ার মন্ত্রী বসে তার ডানপাশে এমপি বা পাশে মেয়র তাদের পিছনের সারি চেয়ারে বসে মন্ত্রী আর এমপির পিএস। 
মন্ত্রী মেয়রের কানে কিছু বলে, মেয়র উঠে গিয়ে উপস্থাপককে কিছু নির্দেশণা দেয়। উপস্থাপক মাইকে বলে ‘উপস্থিত সুধীবৃন্দ, মাননীয় মন্ত্রী, এমপি এবং মেয়র মহোদয় আসন গ্রহণ করেছেন। সুধীবৃন্দ আজকের এই মহতি অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করছেন এই এলাকার গণমানুষের নেতা মতিখালি ইউনিয়ন পরিষদের সুযোগ্য মেয়র জনাব ফসিয়ার রহমান ফসি ভাই। এখন যাদের মহাকর্ম ঘিরে আজকের এই আয়োজন সেই দুই ভাই নরিম ও করিমকে মঞ্চে এসে আসন গ্রহণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।’ 
নরিম করিম সাদা পাজামা পাঞ্জাবির উপর তাদের বাপ-দাদার ট্রাডিশনাল কবিরাজির পোশাক খয়েরি শেরওয়ানি আর কিস্তি টুপি পরে জনগণের ভেতর থেকে স্টেজে উঠে আসে। অনুষ্ঠানের সব মানুষ মুখর হয়ে ওঠে করতালিতে। মেয়র তাদের দুইভাইকে বলে ‘তোমরা এখানে এসে বসো। তারা কাঁপতে কাঁপতে মেয়রের বা পাশের খালি চেয়ারে  বসে। 
মেয়রের শুভেচ্ছা বক্তব্য ভরা থাকে মন্ত্রী এমপির প্রশংসা, তোশামোদ আর আত্মকীর্তন। সে বলে বোঝাতে চেষ্টা করে নরিম করিম যে কাজটা করেছে তার মূল প্রেরণা সে। যা না পেলে তাদের পক্ষে কিছুই করা সম্ভব হতো না।
মেয়রের পর উপস্থাপক বক্তব্যের জন্য নরিমের নাম ঘোষণা করে। নরিম কাঁপতে কাঁপতে মাইক্রোফোনের সামনে নিজেকে টেনে নিয়ে দাঁড় করায়। আট দশটা টেলিভিশন ক্যামেরা তার উপর তাক করা হয়। মেয়র তাকে উৎসাহভরা ইশারা দেয় কিন্তু তা তার কোনো কাজে আসে না। মূর্খতা এবং অনাভিজ্ঞতা থেকে উৎসারিত ভয়ের একটি শক্তিশালী ভাইরাস তার স্মৃতিকা-ের সব শৃঙ্খলা এলোমেলো করে দেয়, যার কারণে তার গত তিন দিন ধরে মুখস্থ করা মেয়রের লিখে দেয়া বক্তব্য  মনে পড়ে না। 
উপস্থিত হাজার হাজার মানুষ নীরবতায় ডুবে অপেক্ষা করে তার বক্তব্য শোনার। সে চারদিকে তাকায় মেয়র তাকে বলে বলো ভয় নাই, মেয়রের এই অভয় তাকে সজাগ করে আর বিভ্রান্তি তাকে নিয়ে যায় বেশ কয়েকদিন আগে লুৎফর মোল্লার গরুতে অন্যের জমির ফসল খাওয়ার অপরাধের এক সালিশ অনুষ্ঠানে। সে অনুভব করে আজকের শালিস বসেছে তাদের দুই ভাইয়ের দেয়াল বানানোর অপরাধের বিচারের জন্য। কাজেই এখানে সবার সামনে কথাবলে  নিজেদের নির্দোশ প্রমাণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে লুৎফর মোল্লা যে ভঙ্গিতে তার বক্তব্য পেশ করেছিলো সে সেভাবেই তার বক্তব্য শুরু করে, এখন তার নিজেকে অনেকটা লুৎফর মোল্লা মনে হয়। সে বলতে শুরু ভয়ে ভাবনায় নুয়ে পড়া কণ্ঠে ‘হাজেরানে মজলিশ, ছালামালাইকুম, আমি যা কোরিছি? আমি না জানে কোরিছি, আমার কোনো দোষ নেই, মেয়র সাহেব সব জানে তার কাছে আপনারা শুনে দেখতি পারেন। আমরা কোবিরাজী করে খাই, আমার আব্বা-দাদা সবাই কবিরাজ ছেলো, আমরাও কোবিরাজি করে খাই। জেবনে আমি কারও খেতি করার চিন্তাও করিনি। এহনও কোরিনা। এই দিয়ালখান একদিন পয়দা হোইনি। অনেকদিন ধরে ছালাম মেস্তরিরে দিয়ে এই দেয়াল গাঁথা হোইছে। ইডা বানাতি যায়ে করিমির বিলির জমি সব শ্যাষ। ক্যা? কোন জেদের পালায় পড়ে এই দেয়াল বানানু হোইছে তা আল্লা কোতি পারে। তয় আপনাগে মানে এই দুনিয়ার কোনো মানুষ পাহি কুলি জিব জানোয়ার কারু কোনো খোতি তো আরমা কোরিনি। খোতি যা হবার তা আমাগে হোইছে। জমি টাকা, সুমায় নষ্ট করে এই আজব দেয়াল আমরা বানাইছি। যহোন বানাইছি তহন বুঝিনি এই নিয়ে এ রহম হৈ চৈ হবে। তা হোলি চোখ ছুয়ে কচ্ছি আমরা এ কাজ করতাম না। আমরা খুব গরীব মানুষ, আপনারা আমাগে মাপ করে দেন। আপনাগে সবাইরে ছালাম, আছছালামালাইকোম। 
সে মাইক্রোফোনের সামনে থেকে সরে এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। দর্শক শ্রোতা হাসি হাততালি আর শিষের ঐকতানে ভরে তোলে দুপুরটাকে। 
এবার বক্তব্য দেয়ার জন্য ডাকা হয় করিমকে। করিম দরকারের চেয়ে অতিরিক্ত দৃঢ় হতে হতে সামরিক ধরণের অশ্লীল রুঢ় ভঙ্গিতে এসে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ায়। এবং অত্যন্ত অমার্জিত চোয়াড়ে খুবই নিম্নমানের হাস্যরস পরিবেশনের অশুদ্ধ উ"চারণে দাড়ি-কমা-সেমিকোলনহীন এক নিঃশ্বাসে দ্রুত আবৃত্তি করে মেয়রের লিখে দেয়া মুখস্থ বক্তব্য তারপর মাইক্রোফোনের সামনে থেকে এসে নিজের জায়গায় বসে। 
উপস্থাপক ঘোষণা করে ‘এবার আজকের অনুষ্ঠানের প্রধানঅতিথি মাননীয় মন্ত্রী আজগর আলী কুট্টি মানুষ জাতির কৃতিসন্তান আমাদের এলাকার গর্ব নরিম-করিম দুইভাইকে তাদের মহত আবিষ্কারের স্বীকৃতি হিসেবে সম্মানজনক মেডেল প্রদান করবেন’। লাল ফিতে বাধা দুইটা নকশা করা পিতলের চাকতি মেয়র তার পাঞ্জাবির ঝুল পকেট থেকে বের করে মন্ত্রীর দিকে এগিয়ে দেয় আর নরিম-করিমকে বলে তোমরা স্যারের সামনে আসো। তারা দুইভাই টেবিলের উল্টাপাশ ঘুরে মন্ত্রীর সামনে আসে। তাদের উপরে টিভি ক্যামরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে। মেয়র তাদের বলে ‘মাথা নিচু করে ঝুঁকে স্যারের দিকে এগিয়ে আয়’ তারা ঝুঁকে গুতো মারার ভঙ্গিতে মন্ত্রীর দিকে মাথা এগিয়ে দেয়। মন্ত্রী প্রথমে নরিমের পরে করিমের গলায় মেডেল পরিয়ে দেয়। জনতা আবার করতালিতে মুখর হয়ে ওঠে। মেয়র নরিম-করিমকে হাতের ইশারায় চেয়ারে এসে বসতে বলে।’ 
এবার বক্তব্য দেয় এমপি, যার প্রায় সবটুকু মন্ত্রীকে তোষামোদ বিরোধী দলের নিন্দা। সে নরিম-করিম সম্পর্কে বলে ‘শুধু খেলোয়াড় হলেই তো হবে না, তার খেলার সুযোগ না পেলে সে খেলা দেখাবে কিকরে? আজ আমাদের পক্ষ থেকে তার খেলার সুযোগ দেয়া হলো, মূল্যায়ন করা হলো তার কাজের, তাকে স্বীকৃতি দেয়া হলো, এটাই আমাদের সফলতা।’ 
অতঃপর উপস্থাপক ঘোষণা করে ‘আজকের এই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি জনগণের নেতা মাননীয় মন্ত্রীমহোদয়কে বক্তব্য উপস্থাপনের বিনম্র আহ্বান জানাচ্ছি। 
মন্ত্রী চেয়ার থেকে ওঠে মাইক্রোফোনের সামনে এসেতার ভুঁড়ির উপরে চর্বির খাঁজে ঢুকে কুচকে থাকা হাতাকাটা কোট ডান হাত দিয়ে ঘষে সমান করতে করতে বলতে শুরু করে ‘পিরিয়ো দেশবাসী, মঞ্চে উপবিষ্ট ভদ্র মহোদয়গণ আমার সালাম গ্রহণ করুন। আজ আমরা জাতির সার্বিক উন্নয়নের এক মাহেন্দ্রক্ষণে এখানে মতিখালির ঐতিহাসিক দেয়ালের পাদপীঠে সমবেত হয়েছি। আজ এই দেয়াল সারা এলাকার মানুষদের এক মিলনমেলায় এখানে যুক্ত করেছে। এই জাতিকে আর দাবিয়ে রাখা যাবে না। আমরা আজ বিশ্বের মাঝে আশ্চর্যজনক এক দেয়াল তুলতে সক্ষম হয়েছি এবং তা নির্মাণ করেছি দেশীয় উপকরণ এবং মেধায়। আমাদের মহান নেতা এই দেয়ালের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন নদী-খাল-বিলের। তিনি আমাদের স্বপ্নের বিবেক, স্বপ্নের পথপ্রদর্শক, তিনার স্বপ্নের পথেই আমরা এগিয়ে চলেছি। হে নেতা তুমি বেহেস্তে বসে নিশ্চয় দেখতে পাচ্ছো আজ তোমার স্বপ্নের পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য দেয়াল আমরা তুলতে সক্ষম হয়েছি। আমি ব্যক্তিগত, আমাদের সরকার এবং দলের পক্ষ থেকে নরিম-করিমকে সাধুবাদ জানাচ্ছি। আমাদের দলীয় এবং সরকারের মূল আদর্শই হচ্ছে দেয়াল তুলতে হবে। প্রতি দুই ভাই প্রতিবেশী, দুই বংশ, দল, দুই দল ছাত্র, সাধারণ মানুষ, চাকরিজীবী, পাড়ায়, মহল্লায়, গ্রামে, গঞ্জে জনে জনে এক বা একাধিক দেয়াল তুলতে হবে। হতে পারে তা মনস্তাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক, দার্শনিক, বিশ্বাস, লিঙ্গনির্ভর, বর্ণ, ধর্ম, মতাদর্শিক বা বস্তুগত। এই দেয়াল জনতার প্রত্যেকের মাঝে তৈরি করবে পরস্পর প্রতিযোগিতার মানসিকতা একই সাথে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনো ধরণের সাহায্য সহযোগিতাহীন অবস্থায় একা একা স্বাবলম্বী হবার সামর্থ্য অর্জনের জিদ। হয় একা একা নিজ যোগ্যতায় টিকে থাকো না হয় ধ্বংস হয়ে যাও, অথর্ব অলস যোগ্যতাহীনেরা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হবে একথা বিজ্ঞানিরা বলেছেন। কাজেই কারও মুখাপেক্ষি হইয়ো না। সূত্র হচ্ছে স্বার্থপর না হলে ব্যক্তিগতভাবে স্বাবলম্বী হওয়া যায় না। তো জনে জনে দেয়াল তুলতে পারলে মানুষেরা প্রত্যেকে একা এবং স্বার্থপর না হয়ে উপায় থাকবে না। ব্যক্তি স্বাবলম্বি হলে দেশও স্বাবলম্বি হবে। বিরোধী দলের ষড়যন্ত্রের লুটপাটের কারণে এদেশের শতকরা আশিভাগ মানুষ এখনও দরিদ্র। যে দেশে আশি ভাগ মানুষ অর্থনৈতিকভাবে অবলম্বনহীন দরিদ্র সে দেশে ব্যাক্তিগত স্বাবলম্বি হতে হলে ব্যাক্তিকে একটু স্বার্থপর না হয়ে উপায় নেই। সেক্ষেত্রে জনে জনে দেওয়াল তুলতে পারলে মানুষেরা একা এবং স্বার্থপর হয়ে উঠবে। অন্য দিকে  দেয়াল মানে আব্রু আর আব্রু মানে আদব। যে জাতির যত আদব সে জাতি তত সভ্য।’ হঠাৎ মন্ত্রির কছিু মনে পড়াতে সে মাইক্রোফোনের কাছ থেকে মুখ সরিয়ে ইশারায় পিএসকে ডাকে। পিএস তার কাছে আসলে তার কানে কানে মন্ত্রী বলে ‘দেয়াল তো বিজ্ঞাপনে ভরে ফেলেছে, মেয়রের সাথে এখনই কথা বলো আমাদের ভাগটা যদি  ঠিকঠাক বুঝিয়ে না দেয় তবে দেয়ালের গা থেকে বিজ্ঞাপন তুলে ফেলতে হবে।’ পলিটিক্যাল পিএস হেসে বলে ‘ওসব নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না। ওসব রফা হয়ে গেছে আপনি বক্তব্য চালায় যান, বিজ্ঞাপনের বিষয়ে আপনি কিছু বলবেন না।’ মন্ত্রী তার কথার কোনো জবাব দেয় না প্রফুল্ল আমেজে বক্তব্যে ফিরে যায় ‘প্রিয় ভাই ও বোনেরা আমরা এই মহান আবিষ্কার রক্ষা এবং সংরক্ষণের জন্য যা যা করা লাগে সব করবো। পুরা জায়গা এ্যাকোয়ার করে আমরা ঘিরে ফেলবো আর এই দেয়াল  সংরক্ষণ এবং নিরাপত্তার জন্য একটা স্বাধীন দপ্তর বানানো হবে। এতো বড় একটা আবিষ্কার গুরূত্ব দিতে হবে। আমাদের নীতি আদর্শের প্রতীক হিসাবে এই দেওয়াল মাথা উঁচু করেদাঁড়িয়ে থাকবে যুগের পর যুগ। প্রজন্মের পর প্রজন্মদেখবে আর অনুপ্রাণিত হবে দেওয়াল তুলতে। মহাকবি কায়কোবাদ বলেছেন যে জাতির মধ্যে জ্ঞানীর কদর নাই সে জাতির মধ্যে জ্ঞানি মানুষ জন্মায় না। আমরা জ্ঞানীর কদর বুঝি, আমরা জ্ঞানীদের রক্ষক এবং জ্ঞান চর্চায় উৎসাহ দেই। নরিম করিমের মত প্রকৃত মৌলিক জ্ঞানীদের সম্মানিত আমরাই করেছি। বিরোধীদলের আমাদের ক্ষমতা থেকে সরানোর নানান ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য জনগণকে সাথে নিয়ে আমাদের যা যা করার আমার তা তা করবো। প্রিয় দেশবাসি আমি এখান থেকে ফিরে দরকার হয় বিদেশি বিশেজ্ঞদের পরামর্শ নেবো। দেশের এবং বিদেশের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি টিম নিয়োগ দেয়া হবে এই দেওয়াল রক্ষা করার জন্য। আমি আইন শৃংখলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত সকল সদস্যকে নির্দেশদিচ্ছি এই দেয়াল এবং দেয়ালকে কেন্দ্র করে যে সাংষ্কৃতিক মেলা চলছে তার নিরাপত্তা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিশ্চিত করতে হবে। জয় আমাদের হবে, হয়েছে, এখন হচ্ছে এবং আগামীতেও হবে। হঠাৎ খুব নিচু দিয়ে উড়ে আসা হেলিকপ্টারের শব্দে সবাই আকাশের দিকে তাকায়। মন্ত্রীর বক্তব্য হোঁচট খেয়ে থমকে যায়। 
পশ্চিম দিক থেকে উড়ে এসে হেলিকপ্টার মেলার উপর  একপাক ঘুরে যায়। লোকেরা মন্ত্রীর দিক থেকে মন আর চোখ সরিয়ে উতলা হয়ে হেলিকপ্টার দেখার জন্য উকি ঝুঁকি দিতে থাকে। মন্ত্রীর কানে তার পিএস বলে ‘হেলিকপ্টারে নায়িকা পাটাই ফাড়া আর কামলালা আসছে আপনার বক্তব্য শেষ করুণ, লোকজন চলে যাবার আগেই।’ মন্ত্রী দ্রুত কি বলে তার বক্তব্য শেষ করে তা কেউ শোনে না।
হেলিকপ্টার মেলার পুব দিকে নির্ধারিত জায়গায় নামে। নায়িকা আসার খবর ছড়িয়ে পড়ে মন্ত্রীর অনুষ্ঠান ফাঁকা করে লোকজনকে ছুটিয়ে নিয়ে যায় যেখানে আকাশ থেকে নায়িকা নেমেছে।
অনুষ্ঠান উপস্থাপক এবং মাইক অপারেটর মাইক চালু রেখেই জনতার সাথে ছুটে যায় নায়িকা দেখতে। জোর বাতাস মাইক্রোফোনে ঢুকে ভয়ঙ্কর সাপের গর্জন হয়ে সাউন্ড বক্স দিয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে....
হেলিকপ্টারের চারপাশে মানুষেরা মরিয়া হয়ে দাপাচ্ছে, চিৎকার করে একজনের উপর দিয়ে আর একজন সামনে যাবার জন্য ঠ্যালা ঠেলিতে ব্যস্ত কিন্তু তাদের একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে অত্যন্ত মারমুখি ভঙ্গিতে আটকে রেখেছে একদল পুলিশ।
মন্ত্রি স্টেজে বসে দেখে হেলিকপ্টারের দরজা খুলে বিশাল ভুঁড়িআলা এক লোক হাসি মুখে দু’হাত উচু করে ডাইনে বায়ে দোলাতে দোলাতে নেমে আসে। তারপর প্রায় কোমর পর্যন্ত দুই পাশ ফাড়া ঘাগরা হাতকাটা বুকের প্রায় অর্ধেক এবং পেটের পুরাটা বের করা গোলাপি জামা পরে নায়িকা পাটাই ফাড়ি আর কামলালা বেরিয়ে আসে। তার পিছনে হলুদ ঘাগরা লাল বড় গলার ব্লাউজ পরা দু’যুবতি নামে।
সখি সহ নায়িকাদের আর্বিভুত হওয়া জনতাকে চরম উত্তেজিত করে তোলে। তাদের উত্তেজনার মাত্রা এতটাই যে ধারণা হয় তারা ভিতরের চাপে এখনই ফেটে যাবে।
মন্ত্রী দূর থেকে দেখে লাল ঘাগরার ফাঁক দিয়ে পাটাই ফাড়ির মাংসল ফর্সা উরু আর বুকের অন্ধকার খাঁজ। তিনি তার শুকিয়ে আসা ঠোঁট চেটে ভিজান আর চরম পানি শূন্যতায় ধুকতে ধুকতে খাবি খেতে খেতে হাওয়া গেলেন...
মন্ত্রীর রাজনৈতিক পিএস ক্যাডার এবং বড় সিন্ডিকেটের মাথা, সে আসপাশে কেউ না থাকলে মন্ত্রীকে ভাই বা লিডার বলে আর লোকজনের সামনে জি হ্যা, আপনি বলেন, কোরছি, যাচ্ছি, ইত্যাদি কোনো সম্মোধন ছাড়া কথা বলে। কিন্তু কখনও স্যার বলে না। চরম বিশ্বস্ত, উপস্থিত বুদ্ধিতে পাকা, যে কোনো বিষয়ে আগাম খোঁজ খবর রাখা এবং একরোখা আনিসুরকে পি এস বানিয়ে মন্ত্রী পুরাপুরি নিশ্চিন্ত। মন্ত্রীর যাবতীয় সদর গোপন ডিল আনিসুরের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত এবং সম্পাদিত হয়। তার উপরে মন্ত্রী নির্ভর করে। পলকহীন চোখে নায়িকা পাটাই ফাড়ির রান দেখে ঠোঁট চাটতে থাকা মন্ত্রির কানের কাছে মুখ বাড়িয়ে খুব গুরত্বপূর্ণ কিছু বলার ভঙ্গিতে আনিসুর বলে ‘পাটাইকে আপনার সাথে একান্তে দেখা করতে বলি?’
‘আ, হ্যা! তুমি না? তোমার জন্য ইজ্জতও রক্ষা করা মুশকিল।’ 
‘কি যে বলেননা লিডার। মন্ত্রী এমপি নেতা বা মিলিওনিয়রদের ইজ্জত কি যৌনাঙ্গে থাকে? যৌনাঙ্গে ইজ্জত থাকে মধ্যবিত্তের, কুলি কামীন চাষাভুসোর। মন্ত্রীর ইজ্জত থাকে পাওয়ারে, সিন্ডিকেট চ্যানেলে। ব্যাংকের হিসাবে, যাক পাটাইকে দেখা করতে বলি?’
‘বলো, তবে বিয়ষটা গোপন রাখতে হবে, চরম ভাবে।’
‘আজই দেখা করতে বলি?’
‘আজ! কোথায় আসবে সে?’
‘আমাদের নতুন বাড়িতে’
 ‘সে তো রাজধানীতে!’
 ‘সেখানেই তো। কোনো সমস্যা?’
‘না সমস্যা নাই, আমরা কখন ফিরছি?’
‘এই  কিছুক্ষণের ভিতরেই’
‘ঠিকাছে চলো আমরা স্টেজ থেকে নেমে সামনের সোফায় বসি।’ 
মন্ত্রী এমপি মেয়র তাদের দুই পিএস এসপি ডিসি সোফায় বসে, তাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে কয়েকজন পুলিশ। বাকি সব চেয়ার ফাঁকা।
সামনে দুই নায়িকা, পিছনে দুই সহচরি, পিছনে পেট মোটা বেটে এক লোক চারপাশে পুলিশের স্বশস্ত্র পাহারায় এগিয়ে আসে স্টেজের দিকে।
অনুষ্ঠান উপস্থাপক দৌঁড়ে এসে স্টেজে ওঠে আর শরীরের সব শক্তি কণ্ঠে জড় করে বলে আনন্দে আত্মাহারা কণ্ঠে ‘সুধী দর্শক শ্রোতা আজ মতিখালি ঐতিহাসিক মহাপ্রাচীরের ছায়ায় জমে উঠেছে তারার মেলা, আমাদের মাঝে এসে উপস্থিত হয়েছেন চিত্র জগতের পর্দা কাঁপানো নায়িকা বিউটিকুইন পাটাইফাড়ি আর কামলালা। সুপ্রিয় দর্শক শ্রোতা আপানারা শান্ত হোন, বসে পড়–ন চুপ চাপ।
দুই সহচরি সহ দুই নায়িকা স্টেজে উঠে আসে। মন্ত্রির পিএসও উঠে আসে স্টেজে আর পাটাই ফাড়ির কানে এখান থেকে ফিরে মন্ত্রীর সাথে একান্তে দেখা করার কথা বলে।  পাটাই হেসে ডানপাশে মাথা কাত করে। পিএস স্টেজ থেকে নেমে আসে আর মন্ত্রীকে বলে ‘আপনি চাইলে আমরা এখন যেতে পারি।’
‘তোমার এদিকের কাজ শেষ?’
‘জী’
‘তাহলে চলো’
মন্ত্রীএমপি গাড়িতে উঠে মেলা থেকে বেরিয়ে যায়...
নায়িকাপাটাইফাড়ি উপস্থাপকের কাছ থেকে মাইক্রোফোন নিয়ে জনতার উদ্দেশ্যে বলে ‘কেমন আছেন আপনারা?’
জনতা দুই হাত উপরে তুলে চিৎকার করে বলে ‘ভালো আছি। ভালো আছি...
পাটাইফাড়ি আবার বলে ‘তাহলে ভালো আছেন আপনারা সবাই? যাক এবার দয়া করে চুপচাপ বসুন আর যারা পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন আপানরা কথা বন্ধ করুন। আমরা এখানে এসে আপনাদের দেখে খুব খুশি হয়েছি। প্রেমে পড়ে গেছি আপনাদের, আমি আপনাদের ভালোবাসি। আপনারা আমাকে আর আমার সাথিদের ভালো বাসেন না? হাত তুলুন কে কে আমাদের ভালোবাসেন?’
জনতা চিৎকার করে দুইহাত উপরে তোলো। পাটাইফাড়া ‘বলে ওরে বাবা বুঝেছি আপনারা সবাই আমাদের খুব ভালোবাসেন, আমি ধন্য আপনাদের ভালোবাসা পেয়ে।’ সে জনতার উদ্দেশ্যে একটা চুমু  মুদ্রা ছুড়ে দেয়।
তুমুল বাজনা বেজে ওঠে সাথে গান ‘রূপে আমার আগুন জ্বলে যৌবন ভরা অঙ্গে... দুই নায়িকা আর তাদের দুই সহচরি সঙ্গমের ভঙ্গিতে কোমর ঝাকায় পরস্পরের মুখোমুখি দাড়িয়ে, তারপর বেদম ঝাকায় স্তন যা দেখে স্টেজের একপাশে দাঁড়ানো অনুষ্ঠান উপস্থাপক মফস্বলের কবিরুল ভয় পেয়ে যায়, তার আশংকা হয় তাদের স্তন ছিঁড়ে রক্তারক্তি দূর্ঘটনা ঘটে না যায়। নিজেদের ঝাকাতে ঝাকাতে দুই নায়িকা একটা কাগজের কার্টুনের ভিতর থেকে গোলাপি মোড়কের সাবান বের করে নিজেদের গালে পেটে শরীরে ঘষে আর মাইকে বলে ‘গোছলের আরাম কাক সাবান আমরা ব্যবহার করি আপনারাও ব্যবহার করুন, এই সাবান ব্যবহার করলে আপনার শরীরের খাউজানি চুলকানি দূর হবে, আপনার ত্বক হবে সুস্থ্য ও জীবানু মুক্ত।’ 
তারা কাটুন থেকে কয়েকখানা সাবান বের করে জনতার মাঝে ছুড়ে দেয়। জনতা হুড়োহুড়ি কাড়াকাড়ি করে সেগুলো কুড়িয়ে নেয়। যারা পায় না তারা আফসোস করে, যারা পায় তারা খুশি হয়। 
আবার বাজনা বেজে ওঠে। নায়িকারা কিছু সময় নিজেদের  ঝাকায়, তারপর কাগজের কাটুনের ভিতর থেকে বের করে আনে একটা ক্রিমের টিউব। লিঙ্গাকৃতির মুখওয়ালা ক্রিমের টিউব সারা শরীরে ঘষে আর বলে, ‘আহ...উহু ....উহ....
এইটা হচ্ছে বনাজি গাছগাছড়া আর কিছু দুঃষ্প্রাপ্য খণিজ পদার্থের নির্যাসের সাথে ভিটামিন মিনারেলের সংমিশ্রণে বিশেষ আয়ূর্বেদিক পদ্ধতিতে তৈরি যাদুকরী গুনের আজব মলম, লাল্টু ক্রিম। এই ক্রিম মাত্র দুই সপ্তাহ ব্যবহারে আপনার ত্বকে এনে দিবে সতেজতা আর আপনি হয়ে উঠবেন ফর্সা কোমল ত্বকের অধিকারী। আমরা এই লাল্টু ক্রিম ব্যবহার করি আর আপনারাও ব্যবহার করুন।’ তারা লাল্টু ক্রিমের কিছু টিউব জনতার মাঝে ছড়িয়ে দেয়। জনতা হুড়োহুড়ি কামড়াকামড়ি করে সেগুলে কুড়িয়ে নেয়।
আবার উদ্দাম বাজনা বেজে ওঠে সাথে গান ‘মনে বড় জ্বালাবে পাঞ্জাবি অলা...
পরবর্তি প্রায় আধা ঘন্টা দুই নায়িকা সাথে দুই সহচরি নিয়ে হাপিয়ে নিজেদের ঝাকায়, জড়াজড়ি করে, বসে শুয়ে ছট ফট করে আর মাঝে মাঝে বলে ‘আ, লান্টু ক্রিম, আহা কাক সাবান, ব্যবহার করতে ভুলবেন না। তাদের ঝাকনি ক্যাকানি, জনতাকে উম্মাদ করে তোলে। তারপর তারা নাচ থামিয়ে পুলিশের পাহারায় স্টেজ থেকে নেমে হেলিকপ্টারে উঠে উড়ে চলে যায়...
নরিম করিম মেডেল গলায় ফাঁকা প্যান্ডেলের সোফায় বসে থাকে। তারা বুঝতে পারে না মেডেল পেয়ে তাদের কি লাভ হয়েছে। নরিম বলে ‘এসব কি সোনার?’
করিম বলে ‘আরে না, পেতল, পাকিস্তান আমলের পিতলের পাচপাই দিয়ে বানানু দুলাল কামারের কাছের তে।’ এ দিয়ে কি অরবো? সুনা হলি তো ব্যাচা যাতো?
মেয়র নরিম করিমকে বলে ‘গেছে সব?খাবা?খায়েনে?সরকার খাওয়ায় দেবেনে? সব কাইড়ে নেবে। শোনোনাই মন্ত্রী ঘোষনা দিছে এই জমি দেওয়াল সব এ্যাকোয়ার করে নেবে?
করিম বলে ‘এমনি এমনি ?’
‘টাকা পাবা জমির দামের সরকারি রেটে, তবে সে টাকা পাইয়ে বুঝেনে ?সরকারের ঘরের টাকা, পানি দিয়ে কানের পানি বের করতে হয়। তুমরা বাড়ি ঘর নিয়ে কোথায় যাবা সেই জায়গায় ঠিক করে রাখো। দেখ কি হয়? আমি চেষ্টা করবো তোমাদের ভালোর জন্য। যাও চিন্তা করে লাভ নাই। এখনও সময় আছে। সরকারি কাজতো অতো তাড়া তাড়ি সিদ্ধান্ত হয় না। মন্ত্রিরা জনসভার অনেক লেকচার দেয় তার কয়টা আর বাস্তবে কার্যকরি হয়? আল্লা আল্লা করো আল্লা যা করে বান্দার ভালোর জন্য করে’
নায়িকার নাচ, মন্ত্রীর ভাষন, ভ্যারাইটি শো, যাত্রাগান, পুতুল নাচের নিচে ঢাকা পড়ে যায় নরিম করিমের ব্যক্তিগত ইমেজ। অবশ্য ছয় সাতটা টেলিভিশন চ্যানেল রাতের সংবাদে প্রচার করে নরিম করিমের বক্তব্যের কিছু অংশ, মন্ত্রীর দেওয়াল এ্যাকোয়ার করার ঘোষণা। নাকিয়াদের নাচ।
একটা টিভি চ্যানেল মতিখালি গ্রামের দেওয়াল আর মেলা নিয়ে টক শো আয়োজন করে। এই টকশো অনুষ্ঠানে এক ধেড়ে শুশিল বলে ‘এই দেওয়াল এক অভূতপূর্ব আবিস্কার। এই দেওয়ালের ভিতরে একটা দর্শণ একটা মনস্তত্ব আছে। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ সিম্বল, অজশ্র কোডের সমন্বয়। এটা কোনো সাধারণ আবিষ্কার নয়। এই দেওয়ালের ভিতরে এই যুগের বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে। যথার্থ বোদ্ধাদের জন্য এই দেওয়ালের ভিতরে রয়েছে জিবজগৎ যুগের অজ¯্র নিদর্শণ। ইতিমধ্যে এই দেওয়াল সুফল ফলাতে শুরু করেছে। অজ¯্র মানুষের কর্মসংস্থান করেছে। একটা পশ্চাদপদ অণুন্নত এলাকাকে আধুনিক নগরায়নে পরিবর্তিত হবার সম্ভাবনা তৈরি করেছে এই দেওয়াল। সময়ের সাথে সাথে এক এক করে দেওয়াল তার কল্যাণকর প্রভাবে প্রভাবিত করবে দেশ জাতি মহাকালকে।
আর এক শুশিল তার গলায় শিরা ফুলিয়ে বলে ‘এই দেওয়ালের ভিতরে অশুভ একটা কিছু অবশ্যই আছে। ইতিমধ্যে এই দেওয়াল ব্যাপক মানুষের জীবনে পাকিয়ে তুলেছে অস্থিরতা। দিন যাবে এই অস্থিরতা প্রসারিত হয়ে জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠবে। এই দেওয়াল ভাঙ্গনের বিভেদের প্রতিক।অশুভ আত্মাদের কারসাজি। এই দেওয়ালকে কেন্দ্র করে মেলার নামে যে বেহায়াপনা জমে উঠেছে তার কোনো সরকারি অনুমোদন নেই। আমাদের সংবিধানে এই ধরনের কোনো দেওয়াল এবং তাকে কেন্দ্র করে মেলা মেলানোর কোনো বিধানের উল্লেখ নেই। কাজেই এই মেলা এবং দেওয়াল সংবিধানের নীতিমালার সাথে সাংঙ্গর্ষিক। বিষয়টা ফয়সালা করার জন্য তিন থেকে পাঁচ সদস্যের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি নির্দলীয় কমিশন গঠন করা উচিত। যে কমিটি দ্রুততম সময়ে তাদের অনুসন্ধানি প্রতিবেদন পেশ করবে এবং এই প্রতিবেদন সংসদীয় কমিটিতে পর্যালোচনা করে সংসদে এটি বিল আকারে পাশ হওয়া দরকার। অবশ্য মাননীয় প্রেসিডেন্ট অ্যাক্ট হিসেবে অনুমোদন করে প্রজ্ঞাপন জারির ভিতর দিয়ে এটা কার্যকরি হতে পারে। আমরা জানি ঐ মেলার কারণে ঐ এলাকার অনেক ফসলি জমি নষ্ট হয়েছে। অনেক মানুষ তাদের দৈনন্দিন দরকারি কাজ ফেলে মেলা নিয়ে মেতে উঠেছে, মেলার খরচ যোগাতে ঐ এলাকার হাস মুরগী নারকোল সুপারি কলা কচু, মাছ গরু, ছাগল সহ অন্যান্য জিনিস চুরি চামারি বিপদজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। কাজেই ঐ মেলাকে এখনই নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সহনীয় পর্যায়ে আনার সময় এসেছে, এটা কোন ধরণের মেলা? যার শেষ হবার কোনো নির্দিষ্ট সময়ে নেই? মানুষেরা আশ্চার্য জিনিস দেখতে আসবে, আসুক, প্রতিদিন আসুক, সমস্যা নাই। তাকে কেন্দ্রকরে মেলা হোক উৎসব হোক কিন্তু তা হোক বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত। সারা সময় মেলা। এটা কি ধরনের ব্যাবস্থা। এটা নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার আর তার দায়ীত্ব সরকারকেই নিতে হবে কোনো ধরনের অতিরঞ্জিত ঘটনা দুর্ঘটনা ঘটার আগেই।  ওখানে মেলার নামে যা হচ্ছে, হতে দেয়া হচ্ছে তাতে এটাই প্রমানিত হচ্ছে জাতিকে কর্ম বিমুখ অলস, দায়িত্বজ্ঞানহীণ ফুর্তিবাজ বানানোর জন্য একই সাথে আমাদের ঈমান আকিদা ধ্বংস করার জন্য এই মেলা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।আমার বিশ্বাস এই ঘটনার  পিছনে বিদেশি ষড়যন্ত্র আছে, ইহুদি এবং মুশরেকরা এই ষড়যন্ত্র সফলের  তৎপরতায় লিপ্ত।
তার কথা শেষ হবার আগেই আর এক শুশিল চড়া গলায় বলতে শুরু করে ‘আপনি যে ইঙ্গিত করছেন আমি তার সাথে দ্বিমত নই। এই দেওয়াল এবং মেলার সাথে বিদেশী ষড়যন্ত্র আছে, অবশ্যই আছে, শুরুতে ছিলো না কিন্তু এখন আছে সেটা অন্য কেউ না আপনার পশ্চিমা জ্ঞাতিগোষ্ঠির ষড়যন্ত্র। শুনুন এসব মহত আবিস্কারকে উৎসাহ দিতে হবে মন্ত্রী মহোদয় যথার্থই বলেছেন যে কবি গোলাম মোস্তফা বলেছেন যে দেশে জ্ঞানীর কদর নেই সে দেশে জ্ঞানী মানুষ জন্মায় না। মেলা-খেলা-নাচ-গান-জারি-সারী-ভাটিয়ালি যাত্রাপালা আমাদের হাজার বছরের জাতীয় প্রেরণার উৎস একমাত্র পাকিস্তানি প্রেতাত্মারাই আমাদের সংস্কৃতির বিরোধীতা করতে পারে। আমরা তো ভালো করেই জানি কে কোন কানেকশনে আছে, কার আত্মীয় স্বজন কোন দেশে থাকে, আর আপনি বাতের হেকিমি চিকিৎসার কথা বলে কোন দেশে কি উদ্দেশ্যে কার কাছে কি জন্য  যান।’
অন্য শুনিল চিৎকার করে বলে ‘আপনি আপনি কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমার প্রতি হিংসামূলক কথা বলেছেন, এটা সভ্য আচরণ নয়।’
দুই শুশিলের ঝগড়ার মাঝে বুক আর কাঁধের অনেকটা বেরকরা ব্লাউজ পরা উস্থাপিকা শরীরে একটা যৌন উসকানি মূলক ভঙ্গি করে কামঘোরে কাতর ন্যাকা ন্যাকা কণ্ঠে বলে ‘আপনাড়া শান্ত হোন, পিলিজ পিলিজ সুধী দর্শক আপনাড়া সাথেই থাকুন ফিরছি ছোট একটা বিরতিড় পর।’ তার কথা শেষ হতেই টেলিভিশনের মনিটর জুড়ে এক ঢেপসি মহিলা শরীরের চর্বি থলথলিয়ে লাফায়, এক কদাকার ভূঁড়িওলা ব্যাটা তার পাশে সোফায় হেলান বসে ঘুমায়। লাফ ঝাপ করা মহিলা বলে মুখ ভেংচে ‘এ্যাতো আরাম যে ঘুম আইসে যায় ছলেমান লুঙ্গি আহা-আহা...উ !
তারপর রাতে শোবার পোশাক পরে তিন ঢেপসি মহিলা দড়িলাফ খেলে আর হাওয়ার বলে ‘একদম ভেতর থেকে শুয়ে নেয় ভিজে চট চটে ভাব থাকে না, জীবাণু মুক্ত আপনি থাকবেন ঝর ঝরে চনমনে বিলকিস স্যানাটারি ন্যাপকিন আহা-আহা-আহা...’
এক অজানা ভয় নরিম করিমকে সারারাত ঘুমাতে দেয় না।
পর সকালে দাঁড়িটুপিঅলা একদল লোক মেলার পাশ দিয়ে দৌঁড়ে মিছিল করে যায়, তারা তাদের পরিচয় দেয় ঈমান আকিদা রক্ষা কমিটি। তারা শ্লোগান দেয় ‘ঈমান ধ্বংসী নাচ গান জুয়া খেলা বন্ধো করো, কোরতে হবে। নারায় তাকবীর-আল্লাহু আকবর। ইহুদিদের ষড়যন্ত্র মানি না মানবো না। দেওয়াল পুজা চলবে না, চলবে না’
মিছিলের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে মানুষের ভিতরে এক ধরণের অস্বস্তি আর সতর্কতা তৈরি করে। হিসাবি মধ্যবিত্তরা এ দিন মেলায় আসে না। দূর থেকে খোঁজখবর নেয়।
মেলায় ডিউটি করা প্রশাসনের লোকেরা একটু অতিরিক্ত সতর্ক হয় আর লোকবল এবং গোয়েন্দ তৎপরতা বাড়ায়। মেয়রকে দেখে কিছুই বোঝা যায় না, সে হাসি খুশি ভাব বজায় রেখে সবাইকে অভয় দেয়। তার একান্ত কাছের কয়েক জন ভলেন্টিয়ারকে বলে ‘সতর্ক থাকতে হবে। দোকানপাট মেলা স্বাভাবিক ভাবেই চলুক তবে যাত্রা আর ভ্যারাইটিশোর নাচ গান একটু আর কি, বুঝলে না? ঠিকাছে?’
নরিম করিমকে মেয়র বলে ‘সমস্যা নাই হাড়ের গন্ধে কুকুরের পাল ঘেউ ঘেউ করছে। কিছু হাড়গোড় ছড়িয়ে দিলেই তারা চাটা চাটিতে ব্যাস্ত হয়ে উঠবে। যাক ওসব আমি ভালই সামলাতে জানি। তোমরা মুখ বন্ধ করে রাখবা আর কেউ ডাকলে কোথাও কারও সাথে যাবে না ঠিকাছে?’
‘জি’
‘যাও বাড়িতে থাকো, সময়মতো আমি তোমাদের ডাকবো বা আমি যাবো তোমাদের কাছে।’
দুপুরের আগে দক্ষিণ দিক থেকে মেলায় একদল লোক আসে ভোটবাজ ভুয়া কমিউনিস্ট অ্যাড জাফর ফরাজীর নেতৃত্বে। এই দলে খোচা খোচা দাঁড়ি ঘুম ঘুম চোখ অপরিচ্ছন্ন পোশাকের কিছু শহুরে যুবক আর প্যান্ট টি শার্ট পরা কিছু নীরস গম্ভীর মুখের যুবতিকে দেখা যায়। তারা ঢোল হারমোনিয়ম নিয়ে দেওয়ালের গা ঘেসে বসে আর গান গায় সম্মিলিত। ‘আরে কালো কালো কালো কাক পাখি ডাকে ধান ক্ষেতের আকাশে,ও কৃষক ভাই শ্রমিক ভাই জাগো জাগো জাগোরে, তোর সোনার ধান খায়ে গেল কালো কাকেরে’ গানের মাঝে মাঝে তারা শ্লোগান দেয় ‘দুঃখ দিয়েই দুঃখ জয় হবেই হবে। তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা।’ তারা এলাকার কেহ বোঝেনা এমন সব বিষয়ের গান গায়, শ্লোগান দেয়, বোতলের পানি আর বেনসন সিগ্রেট পান করে। বড় বড় মোবাইল ফোনে নিজেদের বিভিন্ন পোজের ছবি তোলে।
কিছু কৌতূহলি মানুষ তাদের ঘিরে দাঁড়ায়, পুলিশের সাথে মেয়র তাদের কাছে আসলে তারা বলে ‘আমরা মেলার বিপক্ষে না, আসলে আমরা কারো বিপক্ষে না, আমরা শান্তির পক্ষে। আমরা সম্পূর্ণ অহিংসা এবং শান্তিপূর্ণভাবে একঘন্টা অবস্থান ধর্মঘট করবো তারপর চলে যাবো। দারোগা মেয়রের দিকে তাকায় মেয়র বলে ‘এদের নিয়ে কোনো সমস্যা নাই। এরা এইসব করে বেড়ায়, করুক ওরা কোনো ঝামেলা না, একজায়গায় বসে গান-টান গায় সাধারণ হৈ চৈ করে। ওরা কিছুই না।এখন ওরা বস্তুবাদি বিপ্লবের গালভরা কথা বল্লেও সুযোগ সুবিধা পেলে সব ছেড়ে ছুড়ে হজ করে আসবে, ওদের নেতারা তাইই করেছে। সমাজে একটা প্রতিকী বিরোধিতার ভাব থাকতে হয়, না হলে সমাজ বোর হয়ে যায়। এরা আছে সেই প্রতিকী বিরোধীতার অভিনয়ে। যাক দারোগা সাহেব আপনি একটু খেয়াল রাখবেন যাতে ওদের কেউ উত্তক্ত না করে। ওরা যা করছে করুক, এটাতো মেলা আর মেলায় অনেক কিছুই হয় সবই মেলার অংশ!’
ধর্মঘট কারিদের মাঝ থেকে চুল দাঁড়িআলা একজন দাঁড়িয়ে বলে হ্যান্ড মাইকে ‘বন্ধুগণ আপনারা জানেন গতকাল মন্ত্রী এখানে আপনাদের জমি ঘর বাড়ি উৎখাত করে পার্ক বানানোর ঘোষনা দিয়েছে। আমরা সরকারের এই কৃষক বিরোধী সিদ্ধান্তের পরিবর্তন চাই। আজ সকালে আপানারা জনেন মৌলবাদী চক্র আমাদের জাতিয় ঐতিহ্য এই মেলার বিরুদ্ধে মিছিল করেছে আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই একই সাথে যদি এই কৃষক বিরোধি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না করা হয় তবে আমরা আরো কঠোর কর্মসূচি দেবো। আমরা মোমবাতি জ্বলিয়ে অনশন কর্মসূচি পালন করতে বাধ্য হবো।’ তারা আবার শ্লোগান দেয় ‘তোমার আমার ঠিকনা পদ্মা মেঘনা যমুনা। দেশ বিরোধীদের কম্ম সারা, আমরা সবাই চে গুয়েভারা , হৈ হৈ রৈ রই গেলি কোই, গেলি কোই, তারপর তারা যা বলে তা কেহ বুঝতে পারে না, শুধু শোনা যায় সম্মিলিত কণ্ঠে ‘ জানি না, মানি না, জানি না...
পর সকালে নরিম করিমের মামাতো ভাই সরকারি দলের ক্যাডার মোকলেস আসে তাদের বাড়ি। মেলার প্রথম থেকে এ পর্যন্ত যা যা ঘটেছে নরিম মোকলেসকে বলে। শুনে মোকলেস কিছু সময় চিন্তা করে তারপর একের পর এক ফোন করতে থাকে বিভিন্ন নম্বরে....
দুপুরের ভিতরে মতিখালি এবং তার আশপাশের গ্রামের সরকারি দলের ক্যাডার শ্রেণীর মোটামুটি সবাই এসে জড়হয় নরিম করিমের বাড়ি। মোকলেস তাদের সবাইকে নিয়ে জরুরী বৈঠকে বসে, সে বলে ‘দেখ ভাই বন্ধুরা এই দেয়ালডা আমার ফুপাতো ভাইরা তাদের জমির উপরে তাদের টাকা খরচ করে বানাইছে। যে দেয়ালকে উসিলাকরে এখানে জমে উঠেছে মেলা। যে জায়গায় মেলা হচ্ছে তার বেশির ভাগ জমিও নরিম করিমের। মেলা আর দেয়াল দেখতি সারা দেশের থেকে মানুষ আসতেছি মন্ত্রী, এমপি, এসপি ডিসি, নেতানেত্রী, নায়িকা, টেলিভিশন, পত্রিকার সাংবাদিকরা আসছে। অনেক কোম্পানী, দোকানপাট, সার্কাস, যাত্রা, ভ্যারাইটি শো, পুতুল নাচ এই সব আইছে। সরকার আমাদের, দেশ আমাদের। ক্ষমতায় আমাদের দল। এখন দেশে চলিতেছে উন্নয়নের জোয়ার। মতিখালি এলাকায়ও উন্নয়ন শুরু হয়ছে আর এই উন্নয়ন শুরু হয়েছে এই দেওয়ালের কারণে। বছরের প্রত্যেক দিন এখানে মানুষ আসবে ঘুরবে, দল বাইন্দে আইসে পিকনিক করবে। মেলা চলবে। চলতিই থাকবে যার কোনো শেষ নাই। শেষ হবে না কোনোদিন। এখন কথা হচ্ছে এই মেলা থেকে প্রচুর টাকা আয় হচ্ছে প্রতিদিন, দিনে দিনে যা আরো বাড়বে। এই মেলা থেকে মেয়র তার চামচাদের নিয়ে খাজনা ওঠাচ্ছে আর খাচ্ছে নরিম করিমকে দিচ্ছে দু চারটাকা। মেয়র তো আমাদের দল করে না। সে স্বতন্ত্রপ্রার্থী ছিলো। আমার কথা হচ্ছে আজ থেকে তাকে আর মেলা থেকে এক টাকাও নিতে দেওয়া যাবে না। আজ থেকে এই মেলার যাবতীয় তদারকি খাজনাপাতি আদায় করবো আমরা। আমাদের দলের ভাই ব্রাদারদের নিয়ে মেলা পরিচালনা কমিটি বানাবো। তোমরা এ ব্যাপারে কি বলো ?’
উপস্থিত সবার মাঝ থেকে একজন ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে ‘আমরা কি বলবো মানে ? তুমি তো ঠিক কথাই কইছো। এখনই আমরা মেলারতে মেয়রের চামচাদের ধোলাই দিয়ে ভাগায় দেবো। অন্য আর একজন বলে ‘গরু আমাগে, খড় বিছালি খাওয়ায়ে বড় করিছি আমরা আমাগে গোয়ালে আর তার দুধ খায় নরেন বাবু বাহ ভালো ম্যাজিক তো, না এই সব হতি দেব না। শালাদের ঘাপাতি হবে।’
মোকলেস বলে ‘তাহলি শোনো এমপির ভাগ্নে তবারক আসতিছে, তার সাথে তিন দিন আগেরতে ফোনে আমার সব কথা হইছে। আমি আরো উপরে কথা বলিছি, এখানে আমাদের কোনো সমস্যা নেই, তুবারক এসপি, ডিসি, ওসি সবার সাথে কথা বলে সব ঠিক করে ফেলিছে। এসপি ডিসির কাছে আরো উপরেরতে আমাদের কথা বলে দিছে। কোনো সমস্যা নাই আমাদের ট্রেন চলবে ঠিক লাইনের উপর দিয়ে আমাদের লাইনের সব সবুজবাতী জ্বলে গেছে। তাহলে এখনই চলো আমরা আগে দেয়াল সাফ করবো। সব বিজ্ঞাপন নামায় ফ্যালাবো। দেয়ালে যদি কেউ বিজ্ঞাপন লাগাতে চায় তাহলি দেওয়ালের মুল মালিক নরিম করিমের সাথে চুক্তি করে টাকা দিয়ে লাগাতি হবে। যাদের বিজ্ঞাপন এখন দেওয়ালের গায়ে লাগানো আছে, তারা যদি আমাদের টাকা না দেয় তাহলি তাদের বলতি হবে মেয়র তোমাদের কাছ থেকে টাকা নিছে তার বাড়িতে যাও সেখানে বিজ্ঞাপন লাগাও, ঠিকাছে?’
উপস্থিত সবাই বলে ‘ঠিক আছে মানে? খুব ঠিক আছে।’
হঠাৎ মোকলেসের ফোন বেজে ওঠে, সে ফোন রিসিভ করে বলে ‘আচ্ছা দোস্ত ঠিকাছে আমরা এখনই শুরু কোরতিছি, ঠিকআছে, আচ্ছা - আচ্ছা...’
মোকলেস ফোন পকেটে রাখতে রাখতে হাসি মুখে সবাইকে বলে ‘তুবারক সব কিছু ঠিক ঠাক করে মেলায় আইছে। এই জায়গার ডিউটি পুলিশের কাছেও খবর চলে আইছে, চলো আমরা আমাদের কাজ শুরু করি।’
মোকলেস তার দল নিয়ে দেওয়ালের গা থেকে বিভিণœ কোম্পানীর বিজ্ঞাপন টেনে ছিড়ে তুলুতে শুরু করলে মেয়রের লোকেরা এসে তাদের বাধা দিতে গেলে তারা তাদের প্রচন্ড মারধর করে তাড়িয়ে দেয়! এ সময় পুলিশের দল দূরে দাড়িয়ে এমপির ভাগ্নে তুবারকের সাথে ঘনিয়ে ওঠা মেঘ, মতিখালি বিলের পাকা কই মাছের স্বাদ, আর যাত্রাপালার অভিনয় নিয়ে হেসে হেসে কথা বলতে থাকে। ভ্যারাইটি শোর প্যান্ডেলের মাইকে তখন গেয়ে চলে ‘সাইয়া দিলমে আনারে....
বিজ্ঞাপন দেয়া কোম্পানীর লোকেরা আসলে মোকলেস তাদের বলে ‘এখানে বিজ্ঞাপন দিতে হলে দেওয়ালের মূল মালিকের সাথে চুক্তিপত্র করে লিখিত অনুমতি নিতে হবে। আপনাদের কাছে সে রকম কাগজ থাকলে দেখান?’
বিজ্ঞাপন দেয়া কোম্পানীর লোকেরা মেয়রের কাছে যায়, মেয়র তাদের বলে ‘আসলে লিখিত চুক্তি করে নেয়া উচিত ছিলো নরিম করিমের কাছ থেকে। তারা এভাবে চোখ উল্টাবে আমি স্বপ্নেও ভাবি নাই। এখন তাদের সাথে কোনো লিখিত চুক্তি না থাকার কারণে আপনারা আইনগত কোন সাহায্যও পাচ্ছেন না। আসলে এমপির ভাঙ্গে আর ওদের মামাতো ভাই সব নষ্টের মূলে। যা হোক আপাতত আমাদের চুপ থাকতে হবে আমি দেখছি কতদূর কি করা যায়।’
মেলা পরিচালনার লোকজন পুরো সেটআপ সহ পাল্টে যাওয়ার বিষয়টা দোকানদার, সার্কাস যাত্রা অন্যান্য সবাই স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নেয়। দেয়ালে বিজ্ঞাপন দেয়া কোম্পানীর প্রতিনিধীরা মোকলেসের দলবল আর নরিম করিমের সাথে কথা বলে  কিছু কিছু টাকা দিয়ে চুক্তিপত্র করে ফেলে। সন্ধ্যা নাগাদ মেলা স্বাভাবিক  জমে ওঠে। অন্যদিকে সকাল থেকে আকাশে ভেসে বেড়ানো খন্ড খন্ড মেঘ হঠাৎ সংঘবদ্ধ হয়ে পুরা আকাশ ঢেকে ফেলে। সন্ধ্যার সাথে সাথে আকাশ ঝরাতে থাকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি তার সাথে দক্ষিণ দিক থেকে বয়ে আসা বাতাসের ছোট ছোট ঘূর্ণি যোগ দেয়।
খোলা জায়গায় বসা ছোট দোকানদাররা দোকান গুটিয়ে চলে যেতে থাকে। আকাশের অবস্থা দেখে মেলায় আসা মানুষেরা ফিরতে শুরু করে বাড়ির দিকে। কিছুক্ষণেই বৃষ্টি বাতাসের গতি আর আকৃতি বাড়তে থাকে...
বড় বড় বৃষ্টিভরা বাতাসের ঘূর্ণি যাত্রা আর সার্কাসের প্যান্ডেলের সামিয়ানা আর টিনের বেড়া শব্দ করে ঝাকাতে থাকে। হঠাৎ বিদ্যুৎ সর্বারাহের দুইটা বাঁশের খুটি তার ছিড়ে উপড়ে ফেলে জোর বাতাসের ঘূর্ণি। সাথে সাথে সারা এলাকা গিলে ফেলে তীব্র অন্ধকার এ সময় বৃষ্টিও শুরু হয় অঝোর....
মোকলেস নরিম করিমকে সাথে নিয়ে বিজ্ঞাপন দেয়া কোম্পানীগুলোর কাছ থেকে চুক্তিপত্রের মাধ্যমে যে টাকা নেয় তার থেকে হিসাব মতো সে নরিম করিম কে সাড়ে সাত + সাড়ে সাত মোট পনের লক্ষ টাকা দেয় আর বলে ‘টাকা কিছু বাকি আছে সকালে পাওয়া যাবে তখোন তোমাদের অংশ তোমরা পাবা। টাকা পয়সার হিসাবটা ক্লিয়ার থাকা দরকার কারণ টাকা নিয়েই দুনিয়াতে যত ঝামেলা, তোমরা আমার ভাই বুঝতিতো পারতিছো সব দখল নিয়ে সামলাতি বহুত ঝামেলা আছে,যার যা পাওনা যেখানে যে খরচ তা মিটায় দিলে সব ঝামেলা হাওয়ায় উড়ে যাবে না হলে ঝামেলা এসে সব শেষ করে দিবে। এখন থেকে মেলা থেকে যে টাকা আয় হবে তোমরা তার থেকে পনের পনের ত্রিশ টাকা শতকারা হিসাবে পাবে। এমপির ভাগ্নে তুবারক পাবে বিশ টাকা এই বিশটাকারতে সে উপরে সামলাবে। প্রশাসন পাবে পাঁচটাকা তাহলি কতো হলো পঞ্চান্ন টাকা এর সাথে যোগ করো দশটাকা অন্য যাদের জমি মেলার সাথে আছে তাদের দিতে হবে। মোট পয়ষট্টি থাকে কতো পয়ত্রিশ, মাঠ খরচ, চা সিগারেট অতিথি অন্যান্য টুকটাক প্রতিদিনের খরচ বড় বড় নেতাদের উপহারটার দেওয়া ধরো দশ টাকা তাহলি পচাত্তর থাকে কতো? পচিশ আমরা দোস্ত বন্ধুরা সবাই মিলে এই পচিশ টাকা ভাগ করে নেবো। আর সাইকেল মটর সাইকেল গ্যারেজ থেকে যা হবে তা আমাদের দলের এলাকার ছোট ভাইরা পাবে। মোটামুটি চারপাশ বাইন্দে কাজ করতি হবে কি কও?’
জীবনে এক সাথে এতটাকা নগদ হাতে পেয়ে কাপঁতে কাঁপতে নরিম করিম বলে ‘ঠিক আছে ভাই তুমি যা ভালো মোনে করো তাই করো।’
রাত্রীর সাথে বাড়তে থাকে বৃষ্টি বাতাসের মাত্রা। টাকার চাপ আর বাতাসের হুঙ্কার নরিম করিমকে সারারাত ঘুমাতে দেয় না, শেষরাতের দিকে ঝড়বৃষ্টি থামে কিন্তু আবার যে কোনো মুহূর্তে শুরুর সম্ভাবনায় মেঘ গুমরে বেড়ায়।
নরিম করিমকে বলে ‘মোকলেস বাড়ি আসিনি? সে কুহানে ?’
‘সে তার দলবল সমেত যাত্রা প্যান্ডেলের ছাবড়ার মোদ্দি।’
‘ভালই হোইছে, ভাই চল আমরা বউগের নিয়ে চলে যাই।’
‘ কুহানে ?’
‘যে যার শ্বশুর বাড়ি নগদ টাকা সামলায় থুয়ে আসি, এ্যাতো টাকা কাছে রাখা ঠিক না। তাছাড়া এদিকির অবস্থাও ভালো ঠেকতেছি না আমার, মেয়র কি এমনি ছাইড়ে দেবে ?রাইতেপার্টর সাথে মেয়রের ভালই দোস্তালি আছে।’
‘ঠিক কথা, আকাশের অবস্থাও সুবিধের না, নদীর পানিও বাড়তিছে, চলো আমরা যাই, না হয় সন্দেয় দুই ভাই ফিরে আসপানি।’
নরিম করিম তাদের দুজনের দুই বউ নগদ টাকা কিছু জামা কাপড় সাথে নিয়ে মোরগ ডাকার আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। 
নরিম করিমের শ্বশুর বাড়ি একই গ্রামে এপাড়া আর ওপাড়ায়। মতিখালি থেকে তাদের শ্বশুরবাড়ি পনের মাইল উত্তরে মাকুন্দাপীর নদীর ঐ পারে। তারা দ্রুত হেঁটে পুরা সকাল হতেহতে চারগ্রাম পারহয়ে চলেআসে হবচাতরা ট্রলার ঘাটে। তারা একখানা ছৈ দেওয়া ছোট ইঞ্জিন চালিত নৌকা রিজার্ভ করে রওনা হয় তাদের শ্বশুর বাড়ির দিকে...
নরিম করিমের নৌকা কিছুদূর এগুবার পর শুরু হয় বৃষ্টি বাতাস। প্রবল হুঙ্কার দিয়ে নদীতে বড় বড় ঢেউতুলে ছুটতে থাকে বৃষ্টি বাতাসের বড়বড় ঘূর্ণি। তাদের নৌকা ঢেউয়ের মাথায় নাচতে নাচতে নদীর তীর ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে...
হঠাৎ ঝড় বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে প্রবল শব্দে হুমমুড় ভেঙে পড়ে মতিখালি গ্রামের আকাশ ছোঁয়া দেওয়াল। প্রবল শব্দে বহুদুর এলাকা পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। নরিম করিম আর তাদের দুই বউও চমকে ওঠে শব্দের ধাক্কায়।
মোকলেস তার দলবল সহ ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে যাত্রা প্যান্ডেল থেকে বেরিয়ে দেখে দেওয়ালের ধ্বংসস্তুপে তৈরি হওয়া বিশাল পাহাড়ের নিচে চাপা পড়েছে নরিম করিমের বাড়ি...



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

যে মানুষটা তার দেশ খুঁজে পায়নি

তিনরাত তিনদিন টানা বৃষ্টি-বাতাসের ঘূর্ণি সারা এলাকা তোলপাড় করে ছুটে বেড়ায়।  এই বৃষ্টি বাতাস ঝনঝা উপদ্রুত সময়ের মাঝে কোথা থেকে ঠিক কখন স্...

Pages