এক পলাতক খুনির গল্প - ঋষি এস্তেবান

ঋষি এস্তেবান

সক্রিয় ছোটকাগজের লেখক...

সর্বশেষ লেখা

আপনি জীবদ্দশায় অপ্রাতিষ্ঠানিক থাকতে পারেন, কিন্তু প্রতিষ্ঠান নামের বুনোশুয়োর আপনাকে থাকতে দেবেনা কারণ, তাদের ‘ঘি’ বলেন আর ‘গু’ বলেন কোন কিছুতে ‘না’ নেই

বুধবার, ১৪ মার্চ, ২০১৮

এক পলাতক খুনির গল্প

তীব্র আলোকের মাঝেও বস্তু তার দৃশ্যগত অস্তিত্ব হারায়!
ভয়ংকর শাদা সমস্ত স্থাপনা গিলে ফেলল সবকিছু, মুহূর্তে মুছে গেল নদী, নক্ষত্র, পাহাড়, সমতল, মানুষ, ঘড়ি, ক্যালে-ার, কম্পন, শব্দ এবং ও খেয়ে ফেললো সাদা তিমিরে।
চারপাশ থেকে ছুটে এলো কুয়াশার প্রবল ঢেউয়ের পর ঢেউ আর শাদা একটু ফিকে হতেই হরিৎ পত্র পল্লবে ঢাকা একফালি ভূমি ঝলক মেরে নিজেকে দেখালো, মুহূর্তে পরিপ্রেক্ষিতের ওপারে কিলবিলিয়ে মিলিয়েগেল লাল-নীল-হলুদ তিনটা নদী। আকাশে ঝলসে উঠেই অদৃশ্য হলো একটি রঙধনু আর লকলকিয়ে উঠলো এক অতিকায় তৃষ্ণা।
কিন্তু কোথায়, কিসের জলের শরীরে হাওয়ার নাকি হাওয়ার শরীরে জলের তৃষ্ণা, বিজ্ঞানটা বুঝতে পারার আগেই এক খয়েরি হাওয়ার আলখেল্লা ঢেকে ফেলল আমাকে, সাথে সাথেই সব শাদা পালিয়ে গেল আর সবকিছুর দখল নিলো এক কুহক নীল।
খুন,
খুন,
খুন,
বহুমাত্রিক আতঙ্কের দৃশ্যকল্প হয়ে শব্দটা ছুটছে ঝড়ের মুখে পড়া আগুনের ফুলকি হয়ে...
ঘৃণা আর ক্রোধে বেঁকে যাওয়া জনতার মুখ থেকে উগরানো অনর্গল গালি গালাজের ফাঁক-ফোকর দিয়ে মুহুর্মুহু বেরিয়ে আসছে আমার নাম কারণ আমি মানুষ খুন করেছি। আমার উর্ধ্বতন এখন আঠারো খ- মাংস আর তার মাথাটা স্রেফ খেয়ে কয়েক লাখ সরকারি টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়েছি আমি...
কোথায়? 
কোন পথে, শেষ দেখা গেছে আমার ছায়া, কোথায় আমি যেয়ে থাকি, যেতে পারি তার সুলুক সন্ধান চলছে তন্নতন্ন। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ভীষণ গুরুত্ব দিচ্ছে বিষয়টা, তাদের মেজাজ আরও তাতিয়ে দিচ্ছে দৈনিক বাজারি সংবাদের ব্যাপারীরা। এমনিতেই তাদের বংশ পরম্পরায় উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া যুক্তিহীন অলীক বিশ্বাস এবং মূর্খ অহংবোধে তারা সারা সময় জনতার উপর রেগে টং হয়ে থাকে। তার উপর হঠাৎ ঘটে যাওয়া এই হত্যাকা-ের মূল খুনির কোনো হদিস করতে না পেরে তারা একেবারে হণ্য হয়ে উঠেছে। সাদার উপর কিলবিল লালচে শিরার জালে আটকে পড়া ঘুম ঘুম চোখের সরকারি খুনিরা। আতিপাতি করে আমাকে খুঁজছে। আমাকে মাথায় রেখে শুরু হয়েছে ভয়ংকর গোয়েন্দাবাজী। আমাকে ধরার জন্য ছোট-বড় সরল-জটিল অসংখ্য ফাঁদ পাতা হয়েছে। সবাই জানে আমার রেহাই নেই, আকাশ-বাতাস-মাটি-জল-পর্বত-জঙ্গল যেখানেই পালাই না কেনো প্রতিষ্ঠানের হাতকড়া ঠিকই খুঁজে পাবে আমার হাত কিন্তু আমি সবার চোখের সামনে। সবাই আমাকে দেখছে খুঁটিয়ে অথচ খুঁজে পাচ্ছে না  আর পাবেও না কোনো দিন।
খুব জল-ঝড়-জল। বৃষ্টি বাতাসের কারফিউ। জলভরা বাতাসের বিশাল বিশাল ঘূর্নি ছুটে ছুটে মানুষের ঘর-বাড়ি গাছ এখন বেঘোরে লুটিয়ে দিয়ে যায় যে ভীষণ মায়া লাগে। রাতদিন রাত বৃষ্টি পড়েই চলে অঝোর অফুরন্ত, সূর্যবন্ধ দিন শ্রমহীন ক্লান্তিতে ঝিম ধরা। থমথম আকাশ সবাইকে বেইজ্জতি করার প্রতিজ্ঞা করে প্রস্তুত বসে আছে বেগুন ব্যাপারী আর রাতে রাজ্যের আজগুবি বিভীষিকা চিলবিলিয়ে আমাদের ছেঁকে ধরে। আকৃতিহীন বহুমুখি রহস্যময় আতঙ্ক আমাদের না দেয় ঘুমাতে না দেয় জেগে থাকতে; আমরা কেবলই ঝিম পাড়ি...
চুড়ান্ত অর্থে আমরা যখন নিজেদের ভাবতে শুরু করেছি জলে ডোবা পোকা তখন আমাদের দাপ্তরিক উ"চতর কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ভূমিকর আদায় দপ্তরের থানা পর্যায়ের আদায়কারি দাদার সাথে আমি তার সহকারি হিসেবে জোড় বাধা  হয়ে এখানকার ভূমিকর আদায় কর্তৃপক্ষ নিযুক্ত হোই। আমরা এখানে এসে দপ্তর খুলে বসার সাথেই বৃষ্টির শেষ ফোঁটাগুলো ঝরে পড়ে আমাদের দপ্তরের ছাদে আর খালবিলের সব পানি গুটিয়ে যাক উজানের নদীতে।
উপনিবেশের প্রত্যেক নাগরিকের বছরের ভূমিকর দেয়ার তারিখ এবং ভূমির পরিমাণ হিসাবে টাকার অংক আগেই নিধৃারিত। আমাদের দায়িত্ব ভূমি ভোগকারি প্রত্যেকের কাছ থেকে পূর্ব নির্ধারিত তারিখের মধ্যে ভূমিকর আদায় করে কর প্রদানকারীকে রশিদ দেয়া এবং আদায় করা টাকা ব্যাংকে জমা করে খাত হিসাবে একটি মাসিক আদায় প্রতিবেদন প্রস্তুত করে তার সাথে ব্যাংকে টাকা জমা করা ব্যাংক পে-ইন সিøপ এবং ব্যাংক স্টেটমেন্ট সংযুক্ত করে বিভাগীয় কার্যালয়ে পাঠিয়ে দেয়া। 
আমার উর্ধ্বতনের সব কাজ ধীরস্থির আইন মাফিক, যুক্তিসঙ্গত এবং পরিপাটি । জগৎ সংসারের সবকিছুর প্রতি তিনি অনুভব করেন মানুষ হিসাবে তার মানবিক দায়িত্ববোধ। তিনি জানেন প্রাকৃতিক ন্যায় অন্যায়ের নিগূঢ় জ্ঞান এবং তিনি যা জানেন, যা বলেন তা মেনে চলেন জীবন যাপনে। তিনি এখানে এসেছেন রাজধানী থেকে তার জন্মও হয়েছে সেখানে এক ধনী অভিজাত পরিবারে। রাজধানীর সব অভিজাত ইশকুল কলেজে তিনি লেখাপড়া করেছেন কিন্তু নির্বুদ্ধিতার কারণে তার পূর্বপুরুষরা তাদের ধন-সম্পদ খুইয়ে নিজেদেরকে দেউলিয়ায় পরিণত করেছে যে কারণে তাকে চাকরি করতে আসতে হয়েছে। তার সম্পর্কে এত সব তথ্য তিনি আমাকে দিয়েছেন! 
আর আমি? নিজের সম্পর্কে আমাকে কিছুই জানতে দেয়া হয়নি। এ কথাও আমি কোনোদিন জানতে পারতাম না যদি তিনি আমাকে না বলতেন বুঝিয়ে। আমার জন্ম উপনিবেশের দক্ষিণ পশ্চিমাংশে এক ভূমি মজুরি দাস পরিবারে। সেখানেই বয়স বাড়ে, মোটা সোটা হই আর তিন নম্বর দুনিয়ার গ্রামের সরকারি ইশকুলের কুস্তিগীর অমানবিক শিক্ষকরা আমাকে চরম অত্যাচার করে পিটিয়ে শিখিয়ে একজন নতজানু নফর বানিয়েছে। তারা আমাকে বুঝতে বাধ্য করেছে চুপচাপ চাকরগীরি করাই হচ্ছে শোভন স্বাধীনতা। জন্মসূত্রে মানুষ হিসাবে আমি আসলে যে তারা তাকে খুন করে তাদের পছন্দমাফিক মতাদার্শিকভাবে আমাকে বিনির্মাণ করেছে আর আমার উপর লেলিয়ে দিয়েছে পরলৌকিক লোভ এবং আতংক একই সাথে বর্তমানের সার্বক্ষণিক বিপুল প্রকার আর আয়োতনের অনটন। যে কারণে আমাকে সারা সময় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে আধিভৌত এক দানবীয় হতবুদ্ধিকর ভয় একই সাথে এক অতল লোভ। মূলত তারা আমাকে একজন কমা-ে চলা তাল্পিাবাহক প্রাণী বানিয়েছে। 
উর্ধ্বতনের সাথে আমার সম্পর্ক চুড়ান্ত সৌহার্দ্যরে আমাকে ধমকাবার তার ন্যায্য অধিকার থাকা সত্ত্বেও আমার কাজে কোনো ভুল হলে তিনি আমাকে না ধমকে চমৎকারভাবে বুঝিয়ে বলেন কোনটা ঠিক। আমাদের অফিস বাজারের দক্ষিণ পাশের নদীঘেষা চার রুমের একটা একতলা বাড়ি যার তিন রুম নিয়ে অফিস কার্যক্রম এক রুমে আমাদের সংসার। উর্ধ্বতনের নির্দেশে আমাদের সংসারে আমি এবং আমার শব্দ দুইটা বহিষ্কার করে আমরা এবং আমাদের শব্দ দুইটা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। 
মানবিক সম্পর্ক ছাড়াও উর্ধ্বতনের সাথে আমার রয়েছে নিখুঁত শারিরীক সাদৃশ্য। আমাদের দু’জনের জামা জুতা ঘড়ি আংটির মাপ একই।এমন কি এমন ভয়াবহ আমাদের সাদৃশ্য যে আমাদের দু’জনের শরীর থেকে মাথা খুলে নিলে আমাদের বাবা-মা ও সনাক্ত করতে ব্যর্থ হবে আমরা কোনজন কে? সে ক্ষেত্রে আমার উর্ধ্বতনের এই যৌথ ব্যবস্থায় লাভ আমারই হয়েছে। কারণ আমার সাধারণ কম দামি জামা জুতো তিনি কখনও ব্যবহার না করলেও তিনি আমাকে বাধ্য করেন দামি অভিজাত পোশাক এবং অলংকারাদি পরে ফুল বাবু হয়ে ঘুরে বেড়াতে। 
আকাশের জল ফুরিয়ে যাবার সাথেই উত্তর দিক থেকে গড়িয়ে আসে ফিকে হীম। আর পৃথিবী নিজেকে মেলে দিলো রোদ্দুরে, চারপাশে জেগে উঠলো প্রাণ, কোলাহল। মানুষেরা শরীরের আড়মোড়া ভেঙে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো তাদের কাজ গুছিয়ে নেয়ার জন্য। আমাদের দপ্তরের খাজনা গ্রহণ কাউন্টারের সামনে দু-একজন দুএকজন খাজনা দেয়া লোক দেখা গেল। তারা আমাদের নির্ধারিত টান দেয় আমরা তার বিপরীতে তাদের রশিদ দিই। দু’জনে গ্রামের টাটকা শাকসবজি মাছ কিনি, রান্না করি কেরোসিনের চুলায়, খায় এবং ছুটির সারাদিন অন্যান্য দিনের বিকালে বিলের পথে সতেজ হাওয়ায় ঘুরে ঘুরে গল্প করি। 
তোমার দৃষ্টিশক্তি যত ভালোই হোক বাইরে আলো না থাকলে তুমি কিছুই দেখতে পারবে না এই দেশে একজন মানুষ চল্লিশ বছর বেঁচে থেকে যত পথ হাঁটে, ততপথ সে সোজা যেতে পারলে দেখা হয়ে যেতো সূর্যের ওপাশে কি? কিন্তু হচ্ছে যাওয়া সবাই তাদের অর্জিত যাবতীয় জ্ঞান শিক্ষা দীক্ষাসহ পাক খাচ্ছে একই চৌহদ্দির ভিতর। ভাত বিছানা মাঝে থেকে তাতে মহাকর্ষক শক্তিতে সবাইকে ঘোরাচ্ছে তার চারপাশে। যে কোনো কাজের জন্য অনিবার্য ভাবেই দরকার সম্পদ টাকা-পয়সা টাকা ছাড়া তুমি কিছুই করতে পারবে না। প্রত্যেক ধর্মই বলছে স্রষ্টার ইচ্ছাতেই মানুষেরা সম্পদশালি এবং সম্পদহীন হয়। এক্ষেত্রে যারা অনেক সম্পদের মালিক তাদের বলা হয়েছে যাদের সম্পদ নেই তাদের কিছু দান খয়রাত দিতে। এই দান করলে দানকারীর পুণ্য অর্জন হবে। এই পুণ্য পরে বহুগুণে তাকে ফেরত দেয়া হবে। এই পুণ্যের লোভে সম্পদশালিরা স্রষ্টার পুণ্যের শেয়ারবাজারে লগ্নি করে। অন্যদিকে ব্যক্তিগত সম্পদের জন্ম হয়েছে অন্যের সম্পদ দখলের ভিতর দিয়ে কেউ কারও চেয়ে সম্পদশালি হতে পারে না অন্যের সম্পদ হরণ ছাড়া। এটা বৈজ্ঞানিক সত্য, এই সত্য এটাই প্রমাণ করে কথিত ঈশ্বর সম্পদশালিদের পক্ষে। দুনিয়ায় বহু ধর্ম তৈরি করা হয়েছে কিন্তু কোনো ধর্মেই সম্পদের সমবণ্টন এবং ব্যক্তিগত সম্পদের বিপক্ষে বলা তো হয়ই নি বরং ধর্মগুলোই সমাজে অর্থনৈতিক ধনী-দরিদ্র শ্রেণি তৈরি এবং টিকিয়ে রাখার ঘোরপক্ষে। এক দুই বা কয়েকজন বেশি সম্পদের মালিক হবার কারণেই সমাজের বেশিরভাগ মানুষ দরিদ্রে পরিণত হয়। ব্যক্তিগত সম্পদের প্রতিটা স্থানের জন্য কাউকে না কাউকে সম্পদশূন্য হতেই হয় আর এই সম্পদশূন্য হয়ে দুঃখ কষ্টের ভিতর দিয়ে নিজেদের বাঁচিয়ে রেখে ধনীদের মুনাফা অর্জনের উৎপাদন চালু রেখেছে জগতের মূর্খ মানুষেরা। আমরা জানি, বিজ্ঞান বলেছে বিপর্যয়ের মাঝে তারাই টিকে থাকে যারা শক্তিশালি আর শক্তিশািল হলো তারা যারা জ্ঞানী আর প্রকৃত জ্ঞানী হচ্ছে তারা যারা জানে স্বভাবের সব নিয়ম-কানুন। ভাষা ও সিম্বল এবং এই নিয়ম লংঘনের নিয়ম। কাজেই তোমার নিজের টিকে থাকার জন্যই তোমাকে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। জানতে হবে বিভিন্ন সমাজ রাষ্ট্র প্রকৃতি বিষয়ের স্বভাবের সুর-অসুরের সূত্রাবলী; এই কথাগুলো বলেছিলেন আমার উর্ধ্বতন গ্রামের পথে হাঁটতে হাঁটতে। 
পাতা পাল্টাচ্ছে গাছেরা, গত বসন্তে গজানো সব পাকা পাতা শরীর থেকে খুলে দিচ্ছে আর দূর উত্তরদিক থেকে বয়ে আসা বাতাসের ছোট ছোট ঘূর্ণি জড়িয়ে ঝরাপাতারা আবার গাছে উঠে লেগে যেতে চেষ্টা করছে কিন্তু তারা তা পারার আগেই অন্য বাতাসের ঘূর্ণিরা এসে তাদের এলোমেলো ভাসিয়ে নিয়ে মাটিতে শুইয়ে দিচ্ছে। যতদূর চোখ যায়, মাঠভরা রাই তিশি সর্ষে ক্ষেতের সমারোহ, কয়েক জাতের ডাল পেকে উঠেছে। ঝকঝকে নীল আকাশ ছড়িয়ে দিচ্ছে ঝলমল আলো। মানুষেরা ক্ষেত-খামারে কাজ করছে গল্প করছে আর হাসছে আলোর বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে চরম মদির সৌরভ... 
মনেকরো তুমি যাচ্ছো উত্তর দিকে, আমি যাচ্ছি দক্ষিণে, আকবর বাদশা যাচ্ছে পশ্চিম দিকে, রবীন্দ্রনাথ যাচ্ছে পূর্বে। মনেকরো তুমি যাচ্ছো হেঁটে। রবীন্দ্রনাথ যাচ্ছে উটের পিঠে। আকবর বাদশা যাচ্ছে ঘোড়ার পিঠে আর আমি যাচ্ছি সাইকেলে। আসলে আমরা যে কেউ যাতে চেপে যে দিকেই যাচ্ছি বলে মনে হোক না কেন, আসলে জন্মমাত্র আমরা সবাই একটামাত্র বাহনে এবং একদিকেই যাচ্ছি সেই বাহনটার নাম সময় আর দিকটা হচ্ছি মৃত্যুর দিকে। আসলে মৃত্যু নয় পরিবর্তন পরবর্তি স্তরে গমণ এবং অন্যরূপে অন্য কোথাও বিদ্যমান হওয়া। শক্তির এই এক স্তর থেকে অন্য স্তরে আকারে রূপে বিকশিত হবার মাঝের সময়টুকুর নাম মানবজীবন। বড়ই আশ্চর্য আর বিচিত্র ঘটনা আর রসায়নের সমাহার এই জীবন। জটিল অংক-জ্যামিতি আর রসায়নের স্বয়ংচল ব্যবস্থাপনা একজন মানুষের মানুষরূপে দুনিয়ায় বিদ্যমান থাকা জীবন খুবই সামান্য সময়ের জন্য। এই সময়টুকু আমাদের সুন্দরভাবে ভোগ করা উচিৎ। তুমি সামনে এগিয়ে গেলে স্বাভাবিকভাবে অনেকেই তোমার পিছনে পড়ে যাবে। সামনে বলতে আমি শিক্ষা-দীক্ষা কাজ-চিন্তা-অনুভব এই সব বলছি। তুমি যদি স্থূল আবেগের চাকর হও তাহলে তোমাকে পথে পথে কাঁদতে হবে। 
জীবনকে বোঝা না বানিয়ে জীবনকে বাহন বানিয়ে আমরা চমৎকার সময় পার করতে পারি। আমরা সবাই পরস্পর পরস্পরকে চিনি আবার চিনি না। সব মানুষ পরস্পর পরস্পরের আত্মীয় আবার কেউ কারো কিচ্ছু হয় না। প্রত্যেক সংখ্যাই মৌলিক এবং একক। সব মানুষই একা। সবই চরম অর্থবহ আবার কোনো কিছুরই কোনো মানে নেই। কিছুতেই কিছু এসে যায় না। প্রত্যেকেই নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। রবি ঠাকুরের জন্ম হইছে ভালো হইছে কিন্তু সে না জন্মালে পৃথিবী থেমে যেত এমন নয়। পৃথিবীর হাজার লক্ষ মানুষ রবি ঠাকুরের নামও শোনেনি তাতে যে তাদের কোনো সমস্যা হয় এমন নয়, নিজেকে খুব বেশি ভালোবাসা এবং গুরুত্বপূর্ণ মনে করার কোনো কারণ নাই। কাউকেই জগৎ সংসারের জন্য চুড়ান্ত অপরিহার্য্য ভাবাটাও বোকামি। প্রকৃতিতে তার সন্তানদের যা যা দরকার তার সব তার কাছে আছে, শুধু খুঁজে নিতে হবে। 
আমাদের কাজ করা উচিৎ বিদ্যায়তনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, সব আবেগ, পক্ষপাতিত্ব ঝেড়ে ফেলে কোনো ব্যক্তি নয় বিষয়ভিত্তিক কাজ করার দৃঢ় মানসিকতা নিয়ে। যেমন একজন চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র দেহ গঠনপ্রণালি পরীক্ষাকরে তখন ওই ব্যাঙের কতটুকু কষ্ট হচ্ছে তা নিয়ে ভাবলে এবং তার যন্ত্রণা জীবন বিষয়ে আবেগ প্রবন হয়ে পড়লে ওই চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্রের গবেষণা সফল হবে না, ওই ছাত্রের তার বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানচর্চায় সামনে এগোনো হবে না। অবশ্য তুমি আবেগের চাকর হয়ে বসে বসে ঘ্যানঘ্যান করতে করতে হতাশার সরোবরে সাঁতার কেটে কেটে তোমার জন্য প্রকৃতির বরাদ্দ সময়টুকু শেষ করে ফেলতে পারো। আসলে তুমি কি করবে আর কি করবে না তা তোমাকেই ঠিক করতে হবে। অজস্র পথ আমাদের পূর্বপুরুষরা তৈরি করেছে, এখনও তৈরি হচ্ছে। এই সবের যে কোনো পথে তুমি চলতে পারো, প্রচলিত পথ তোমার পছন্দ না হলে নিজের মতো করে বানিয়ে নিতে পারো নতুন কোনো পথ। যে কোনো কাজের জন্য নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হবে কিন্তু আমি এখনও নিজেকে যোগ্য করে তুলতে পারিনি আমার কাজ শেষ করার জন্য। আমার দুজন বন্ধু সফল করে তুলতে পেরেছে তাদের স্বপ্ন, তারা চলে গেছে এদেশ থেকে মাত্র সফলের দেশে। আমিও যাব ইউরোপের বা আমেরিকার কোথাও। এখান এই প্রায় বর্বর মানুষদের মাঝে আমাদের কোনো কাজ নেই। মনে করো একটা দ্বীপের মাঝে পাঁচশ একজন মানুষ আছে। এর মাঝে পাঁচশ জনই বোবা, তাহলে কি দাঁড়াচ্ছে বোবারা তো বোবাদের মতো কথা ইশারা সিস্টেমে সবার সাথে সবার যোগাযোগে কোনো অসুবিধা হবে না। ওইখানে ওই যে একজন কথা বলতে পারে সেই আসলে বোবা হয়ে যাবে। তো আমার অবস্থা ওই কথা বলতে পারা মানুষটার মতো। এখানে আমার কথা-চিন্তা-ইশারা কেউ বোঝে না, আমি তাদেরটা কিছু বুঝি। কিন্তু এখানে চালু কালচার আমি আয়ত্ব এবং ধারন করে সবার সাথে সবার একজন বানাতে পারি না নিজেকে। 
তো আমার চারপাশের এতো মানুষকে তো আর আমি পরবর্তিত করতে পারি না আমার কাছে এমন কোনো ম্যাজিক নেই যা দিয়ে এদেশের মানুষের মন থেকে সব পশ্চাদপদতা মুহূর্তে ভরে সেখানে প্রতিস্থাপিত হবে সর্বাধুনিক চিন্তা চেতনা কালচার! কাজেই আমিই এখান থেকে উপরে নিয়ে নিজেকে সেখানেই পুতে দেবো যেখানে আমার ভাবনা চিন্তা আগ্রহগুলো জ্যান্ত হয়ে উঠবে আর নিজের জ্ঞান, হয়ে ওঠা স্বপ্নের রাজ্যে বসত করতে কে না চায়? চাওয়া উচিৎও বটে। 
আমি চলে যেতাম আমার স্বপ্নের রাজ্যে কিন্তু আমি আঁটকে আছি টাকা অনটনের কারণে, তবে আশা করছি শীঘ্রই অর্থের একটা ব্যবস্থা করে ফেলতে পারবো। আমি এই দেশটাকে ভালোবাসি কিন্তু কুসংস্কার আর অলীক বিশ্বাস এবং আশার টলোমল মানুষের প্রায় বন্য জীবনটাকে আমি ঘৃণা করি। তোমাকে দেখাতে পারি পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স পাশ করা মানুষেরা সম্পূর্ণ অশিক্ষিত পীর বা সাধুর চ্যালা হয়েছে। তাহলে শিক্ষা যদি তোমার কুসংস্কার আর অন্ধত্ব ঘোঁচাতে না পারে তবে সে শিক্ষার কি প্রয়োজন?
যদি তুমি অনাগত মানুষের জন্য অন্ধকার জঙ্গলের মাঝ দিয়ে আলোকিত পথ বানাতে চাও তবে হয়ত কিছু পোকামাকড় বন্যপ্রাণীর ঘরবাড়ি জীবন ধ্বংস হবে। এক্ষেত্রে যদি তুমি ওইসব পোকামাকড় প্রাণীদের জন্য মায়া করে ঘরে বসেথাকো তবে তো তোমার ওই পথ বানানো হবে না। আমি চলে যাবো এই অসভ্য বর্বরদের সমাজ ছেড়ে যেখানে উদ্দাম জীবন-গতি-নতুন চিন্তা-আবিষ্কার-স্বাধীনতা-কাজ সেখানে। এখানে আমার কাউকে আপন মনে হয় না, বাবা যা আমাকে ছেড়ে অনেক আগেই পরপারে চলে গেছে। ভাইবোন বংশের যারা আছে তারাও ভেসে চলেছে কুসংস্কারের বিপুল প্রবাহে। তাদের প্রতি আমার কোনো টান নেই। মানুষতো নিজের স্বপ্ন পূরণের চিন্তা এবং চেষ্টাই করে সারাজীবন। এইসব কথা সম্মান আমার উর্ধ্বতন বলছিলো তখন তাকে কেমন অচেনা মনে হয় আমার, কেন যেন তার জন্য আমার দুঃখ হতে থাকে, আমার ইচ্ছা হচ্ছিলো তাকে বলি এ দেশটাতো আপনার মাতৃভূমি, অনেক জ্ঞানী, মানবদরদি উন্নত হৃদয়ের মানুষের জন্ম হয়েছে এখানে। লালন, হাসন, এস এম সুলতান, জীবনানন্দ আরও আরও অজস্র মহৎ মানুষ এই মাটির সন্তান। আপনি নিজেও একজন জ্ঞানী এবং ন্যায়বান মানুষ। আপনি যাদের কথা বলছেন তারাতো সারা দুনিয়ায় সরল রাষ্ট্রের ধন সম্পত্তি লুটপাট করে গড়েছে তাদের সুরম্য নগর। আজও তারা সারা দুনিয়ায় জারি রেখেছে ষড়যন্ত্র লুটপাট দখল দাঙ্গা-হত্যা-যুদ্ধ অমন দস্যুদের দেশে আপনি কেনো যাবেন, আপনার শিক্ষা-কালচার-জ্ঞান এদেশের মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিন। আমি সারাজীবন আপনার সাথে থাকবো। আরও অনেকে আসবে কাজ করবে। আসুন আমরা শুরু করি কুসংস্কার কূপমু-কতা অপসারণের কাজ কিন্তু কথাগুলো আমি তার কথা থামিয়ে তাকে তখন বলতে পারিনি, আজও পারিনি। 
হঠাৎ আমাদের দাপ্তরিক কাজ বেড়ে গেল। সকাল থেকে সন্ধ্যা খাজনা পরিশোধ করতে লোকজন আসছে তো আসছেই, খাজনা দিতে তাদের এত আগ্রহ যেন আসছে টাকা নিতে। মাসের শেষ দিন আবহাওয়া গুমোট আর একঘেয়ে নিরানন্দ কাজে জর্জর। শেষ বিকালে আমার খাজনা দেয়া শেষ লোকটা ধীর স্থির আয়েশী ভঙ্গিতে আঙ্গুল থুথুতে ভিজিয়ে দুবার গুনে খাজনার টাকাগুলো দিয়ে রশিদ নিয়ে চলে গেল। আমি একটা লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে উর্ধ্বতনকে মনে করিয়ে দেই আমাদের ক্যাম্পে প্রচুর টাকা জমা হয়ে আছে, প্রায় পনেরদিন আমরা ব্যাংকে টাকা জমা দেয়না, আজকের দিনও শেষ। 
আমার কথার উত্তরে বললেন, বছরের এই সময় এরকম হয়েই থাকে। আগামী সকালে আগে ব্যাংকে ক্যাশের সব টাকা জমা করে পরপর অন্য কাজ করবো; এখন চলো খোলা বাতাসে একটু ঘুরে আসি। 
খোলা মাঠের পথে ঘুরে আমরা ফিরতে ফিরতে রাত নয়টা। তালা খুলে প্রথমে ঘরে ঢুকলাম আমি, পেছনে মুক্তিরও মন্দিরও সোপানও তলে কতো প্রাণ হলো বলিদান-গাইতে গাইতে উর্ধ্বতন ঘরে ঢুকে দরজার হুড়কো তুলে দিয়ে বললেন, ‘আমি আহম্মেদ, তুমি চাইলে আমরা ক্যাশের টাকাগুলো এখনই গুনে টুনে গুছিয়ে রাখতে পারি যাতে সকালে প্রথমেই আমরা টাকাগুলো ব্যাংকে জমা করতে পারি।’ 
আমি বললাম ‘হ্যাঁ, তাহলে খুব ভালো হয়।’ তিনি লম্বা একটা শোকের নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন ‘আমাদের পবিত্র ধর্মে বলা হয়েছে যে নিজেকে সাহায্য করে না, স্রষ্টাও তাকে সাহায্য করে না, তোমার কাজ আগে তোমাকেই শুরু করতে হবে কী বলো?’
হঠাৎ দড়িটা এসে পেঁচিয়ে যায় আমার শ্বাসনালিতে আর আমার উগড়ানো চিৎকারটা আঁটকে যায় দড়ির ফাঁসে আর আমি দেখলাম আমার মুখের সামনে ঝুলছে কৌতুক এবং আগ্রহে চকচকা উর্ধ্বতনের দুই চোখ। আমি ধারণা করলাম এটা একটা ঠাট্টা, তিনি আমাকে চমকে দিতে চান মজা পাওয়ার জন্য কিন্তু দড়ির ফাঁসটা তীব্রভাবে আমার গলায় চেপে বসতেই আমি চমকে উঠলাম আর দেখলাম ভয়ংকর গতিতে আমার দিকে চারপাশ থেকে ছুটে আসছে ফ্যানায় ফ্যানায় ভরা শাদা তরঙ্গ...
মুহূর্তে ফুঁসে ওঠা সেই শাদায় আমি হারিয়ে ফেললাম আমাকে...



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

যে মানুষটা তার দেশ খুঁজে পায়নি

তিনরাত তিনদিন টানা বৃষ্টি-বাতাসের ঘূর্ণি সারা এলাকা তোলপাড় করে ছুটে বেড়ায়।  এই বৃষ্টি বাতাস ঝনঝা উপদ্রুত সময়ের মাঝে কোথা থেকে ঠিক কখন স্...

Pages